প্রতিনিধি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বলা হয় আমের রাজধানী। আর এ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম আমবাজার কানসাট। তবে এই আমবাজারে আড়তদারদের কাছে জিম্মি সাধারণ চাষিরা। গণিতের হিসেবে ৪০ কেজি ধরে এক মণ কেনাবেচা হলেও এই হাটে এক মণ হয় ৫২ কেজিতে। ক্ষেত্রবিশেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ কিংবা ৫৫ কেজিতেও।
জানা যায়, প্রতি মণে ১২ থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত অতিরিক্ত দেয়ার এই প্রথাকে ঢলন বলা হয়। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় গ্রাম থেকে আসা চাষিদের। বাজারের আড়তদাররা সম্মিলিতভাবে হুমকি দেন আম না কেনার। আর স্থানীয় প্রশাসন এসব কিছু জেনেও দর্শকের ভূমিকায় থাকে বলেও অভিযোগ বাগান মালিকদের। সরেজমিন শনিবার দিনব্যাপী কানসাট আম বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
কানসাট বাজারে ক্ষীরশাপাতি আম বিক্রি করতে এসেছিলেন আব্বাস বাজার এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান হাবিব। তিনি বলেন, গত চার বছর আগে আমরা ৪২-৪৩ কেজিতে মণ ধরে আম বিক্রি করেছি। কিন্তু ২০২২ সালে ৪৮ কেজিতে মণ ধরে আম ক্রয় করেন আড়তদাররা। সেই থেকে বছর বছর বাড়ছে ওজনের পরিধি। চলতি বছর ৫২ থেকে ৫৫ কেজিতে মণ ধরে আম ক্রয় করছেন তারা। আমরা এখন বিপাকে। কোথায় যাব, কার কাছে বলব এ অনিয়মের কথা।
মুসলিমপুর গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, এ বছর অন্য বছরের থেকে গাছে আম অনেক কম এসেছে। এদিকে আম বিক্রি করতে এসে শুনছি ৫২ কেজিতে এক মণ ধরা হবে। এতে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। গত বছরও আমাদের জিম্মি করে ৫০ কেজিতে মণ নিয়েছেন আড়তদাররা। এবার ফের ৫২ কেজিতে মণ নিচ্ছেন। অনেক সময় টালবাহানা করে অন্তত ৫৫ কেজিতে আমের মণ নিচ্ছেন আড়তদাররা।
শ্যামপুর চৌধুরীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আসমাউল হাসান বলেন, এবার ৭০ শতাংশ বাগানেই আম নেই। বাগানে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বাজারে এসে শুনছি মণে ১২-১৫ কেজি আম বেশি দিতে হবে। এখন আপনি বলেন, আমরা কোথায় আম বিক্রি করব।
এ বিষয়ে কানসাট আম আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু বলেন, শুধু কানসাট নয়, রাজশাহী, নওগাঁ, গোমস্তাপুর, ভোলাহাটÑসব স্থানেই বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। আমরা চাই রাজশাহী বিভাগের সব আমের বাজারে এক ধরনের ওজন নির্ধারণ করা হোক। এটি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। আমারা বিষয়টি নিয়ে কয়েক দিন আগেও বৈঠকে বসেছিলাম। কিন্তু রহনপুর ও ভোলাহাট আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, আমরা কষ্ট করে আম উৎপাদন করি। কিন্তু আড়তদাররা মণে ১২-১৫টা আম বেশি নিচ্ছেন। ৫০-৫৫ কেজিতে মণ ধরে আম কিনছেন তারা। এ অনিয়ম কয়েক বছর আগে থেকেই হয়ে আসছে। আমরা এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে মুক্তি চাই।
তিনি আরও বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও রাজশাহীতেও আমের ওজন নিয়ে ঝামেলা হয়। আমরা চাই সব আম বাজারে ওজনের মাপ যেন একই হয়। আমরা কৃষিমন্ত্রীর কাছেও অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম বলেন, জেলায় মোট তিনটি আম বাজার, একেক বাজারে একেক ওজন চলে। তাই আমরা তিনটি আম বাজার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসেছিলাম, কিন্তু সমাধান করতে পারিনি। এখন কানসাটে ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম ক্রয় করছেন আড়তদাররা।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. উজ্জ্বল হোসেন বলেন, কানসাট আম বাজারে ওজন নিয়ে ঝামেলার বিষয়টি শুনেছি। ঈদের পর আর খোঁজ নেয়া হয়নি। কোনো আমচাষি আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেননি। তারপরও আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব।
এবার জেলায় চার লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ, যা গত বছর ছিল চার লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে কৃষি বিভাগের লক্ষ্যামাত্রা বাড়লেও আমের উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ গাছেই এবার আম হয়নি।