Print Date & Time : 30 June 2025 Monday 9:32 pm

৫৫ বছরের পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে চলছে রাসায়নিক পরীক্ষাগার

সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ রাসায়নিক পরীক্ষাগারে নেই প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একাধিকবার চিঠি দিয়েও কাজ হয়নি। বছরের পর বছর পার করলেও আসেনি কোনো নতুন সরঞ্জাম। বর্তমানে যেসব সরঞ্জাম দিয়ে রাসায়নিক পরীক্ষা হচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগ ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে ক্রয় করা। ফলে পুরোনো ও এনালগ সিস্টেমের যন্ত্রপাতি দিয়ে চালাতে হচ্ছে রাসায়নিক পরীক্ষাগার। এছাড়া বিদ্যমান পদগুলো আপগ্রেড করে জনবল কাঠামো ঠিক করলেও এখন পর্যন্ত এনবিআর চূড়ান্ত করতে পারেনি নিয়োগবিধি।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, নিয়োগবিধি চূড়ান্তকরণের নথিটি আইন মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন পড়ে আছে। তবে এর কিছু অংশ সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয় অনেক দিন আগে এনবিআরে প্রেরণ করা হয়। তবে এখনও পর্যন্ত এনবিআর ফাইলটি আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠাতে পারেনি। ফলে রাসায়নিক পরীক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় কাউকে নিয়োগ দিতে পারেনি এনবিআর। চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে এনবিআরকে দেওয়া চিঠিও পড়ে আছে হিমাগারে।
এদিকে দেশের আমদানি-রফতানির ৯২ শতাংশ কার্যক্রম হয়ে থাকে কাস্টম হাউসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সেখানে প্রতিদিন আমদানি-রফতানির পণ্যেও অনেক নমুনারই রাসায়নিক পরীক্ষা করতে হয়। পর্যাপ্ত আধুনিক সরঞ্জাম না থাকায় সব ধরনের পরীক্ষা করতে পারছে না এই পরীক্ষাগার। ফলে বহিঃল্যাবে পাঠাতে হয় অনেক নমুনা। এতে পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে দেরি ও শুল্কায়নে বিলম্ব হচ্ছে। তাতে রাজস্ব হারাচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ।
শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের রাসায়নিক পরীক্ষাগারের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক ইকুইপমেন্ট টিওঅ্যান্ডই’তে অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য ২০০৬ সাল থেকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, এনবিআর ও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের মধ্যে বেশ কিছু চিঠি চালাচালি হয়েছে। সর্বশেষ নথি নং- এস/০২/কাস/কেমি:ল্যাব/শুভচ/২০০২-২০০৩তে চট্টগ্রাম কাস্টমস ল্যাবরেটরি ২৩ কোটি সাড়ে ৭৬ লাখ টাকার ১২১টি সরঞ্জাম চেয়ে এনবিআরে চিঠি পাঠালেও বরাদ্দ আসেনি কোনোটিরই।
ওই চিঠিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস আটটি সূত্র উল্লেখ করে এনবিআরকে বলা হয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিটি আধুনিকায়নের জন্য এনবিআর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে জনবল বৃদ্ধি, নতুন পদ সৃষ্টি এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপন। জনবল বৃদ্ধি ও উচ্চতর স্কেল প্রদানসহ নতুন পদ সৃষ্টির বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে অনুমোদিত হয়েছে। জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা অত্যন্ত জরুরি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পণ্য আমদানি হয়। মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি রোধ ও সঠিক শ্রেণিবিন্যাস করে রাজস্ব আহরণ নিশ্চিতে রাসায়নিক পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। ল্যাবরেটরিতে বিদ্যমান যন্ত্রপাতি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার যেসব যন্ত্রপাতি বিদ্যমান আছে, সেগুলো খুবই পুরোনো ও এনালগ, যা ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে ক্রয় করা। এছাড়া আগের তুলনায় কেমিক্যাল ল্যাবরেটরির কার্যপরিধি বর্তমানে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ল্যাবে অনেক রাসায়নিক পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব পণ্য বহিঃল্যাবে পাঠাতে হয়। বহিঃল্যাব থেকে পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে অনেক সময় লাগে। এতে শুল্কায়নে বিলম্ব হয়। তাই সঠিক ও দ্রুত শুল্কায়নের স্বার্থে কাস্টম হাউজের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা খুব জরুরি।
অনুসন্ধান আরও দেখা যায়, বিভিন্ন জটিল মিশ্রণের উপাদান শনাক্তকরণে ও পরিমাণগত বিশ্লেষণের জন্য আধুনিক গ্যাস ক্রোমেটোগ্রাফ (জিসি), হাইপারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমেটোগ্রাফ (এইচপিএলসি) এবং আলট্রাভায়োলেট ভিজিবল স্পেকটোফটোমিটার (ইউভিভিআইএস) নামে আধুনিক তিনটি ইকুইপমেন্ট থাকলেও এগুলো অব্যবহƒত অবস্থায় পড়ে আছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে পিএসআই সংস্থাগুলো ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের এসব যন্ত্রপাতি দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমকে। কিন্তু এগুলোর সহায়ক সরঞ্জাম প্রদান না করায় ১০ বছরে একদিনের জন্যও চালু করা সম্ভব হয়নি এসব মেশিন।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, গ্যাস ক্রোমেটোগ্রাফ (জিসি), হাই পারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমেটোগ্রাফ (এইচপিএলসি) স্থাপন ও চালু প্রসঙ্গে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ থেকে বাংলাদেশ জাতীয় রাসায়নিক অস্ত্র কনভেনশন কর্তৃপক্ষের (বিএনএসিডব্লিউসি) চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে দুটি সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়, মেশিন দুটি চালু করার জন্য যেসব আনুষঙ্গিক যন্ত্রের প্রয়োজন, তা এখনও কেনা করা সম্ভব হয়নি। ওই চিঠির সংযুক্ত কপিতে আরও বলা হয়, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ চেয়ে বহুবার এনবিআর বরাবর চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। মূলত বাজেট বরাদ্দের অভাবে মেশিন তিনটি এখনও চালু করা হয়নি। তবে আনুষঙ্গিক সাতটি যন্ত্রের মধ্যে চারটি কেনা হয়েছে। বাকি তিনটি অর্থের অভাবে এখওন কেনা সম্ভব হয়নি।
জানা যায়, বর্তমানে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে যে ২২টি সরঞ্জাম রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি অকেজো। এদিকে বিদ্যমান অরগানোগ্রাম অনুসারে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পদসংখ্যা ১৬টি থাকলেও নিয়োগ আছে মাত্র ছয়জন। তাছাড়া প্রধান দুটি পদে এখনও পর্যন্ত কোনো পরীক্ষক নিয়োগই দিতে পারেনি এনবিআর। এছাড়া কাস্টমসে যে ক’টি ল্যাবরেটরি আছে, সেখানেও হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে প্রস্তাবিত নতুন অরগানোগ্রামে ৯৩টি পদসংখ্যা রাখা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ল্যাবে তরল কোকেনসহ মিশ্র মাদক পদার্থের পরিমাণগত বিশ্লেষণের পরীক্ষার কোনো সুবিধা নেই। ফ্লেইম ফটোমিটার, ভিসকোমিটার, ফিউরিয়ার ট্রান্সফ্রম ইনফারেড স্পেকট্রোকপি, ক্লাউড পয়েন্ট ডিটারমিনেশন অ্যাপারেটাস, এক্স-রে ক্রিসটালোগ্রাফি, ফ্রিজিং পয়েন্ট অ্যাপারেটাস, নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রিজোন্যান্স (এনএমআর), ইন্ডাকটিভলি কাপল্ড প্লাজমা ইমিশন স্পেকট্রোসকপি, ইউনিভারসাল টেস্টিং মেশিন ফর মেটাল ও সুপারক্রিটিক্যাল ফ্লুইড ক্রোমেটোগ্রাফির মতো আধুনিক সরঞ্জামের অভাব রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস ল্যাবরেটরিতে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ইনচার্জ মো. হান্নান বলেন, ‘বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম ও লোকবল না থাকার পরও আমরা নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছি। প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত পরিমাণ লোকবল থাকলে সেবার মান আরও বৃদ্ধি পেত। সীমিত সরঞ্জামের মধ্যেও রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষকরা যে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো নির্ভুলভাবে করে যাচ্ছেন, সেটা প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ এখানকার পরীক্ষকরা দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে অনেক অভিজ্ঞ। এছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টমস ল্যাবরেটরির মাধ্যমে মাসে গড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা রাজস্ব খাতে যোগ হচ্ছে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক আধুনিক যন্ত্রপাতি ও জনবল থাকলে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ আরও অনেকগুণ বেড়ে যাবে বলে আমরা মনে করি।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাসায়নিক পরীক্ষাগারের যন্ত্রপাতি ব্যবহার উপযোগী নয় বলে মনে করেন বিকেএমইএ’র সাবেক পরিচালক শওকত ওসমান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সাধারণত যে কোনো সরঞ্জামের মেয়াদ থাকে পাঁচ থেকে ১০ বছর। সেখানে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের অধিকাংশ সরঞ্জাম পুরোনো ও এনালগ। এছাড়া আমরা স্বাধীনতার আগের যন্ত্রপাতি এখনও গ্রহণ করব কেন? সেগুলোর তো মেয়াদ থাকার কথা নয়।’
নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজনের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা খুব দ্রুত ল্যাব আধুনিকায়নের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এনবিআরে পাঠানো হবে। এছাড়া যে মেশিনগুলো ভালো আছে, সেগুলো রেখে বাকিগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হবে।’