রহমত রহমান: দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৫ সালে যেখানে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ ২০ হাজার। সেখানে ২০২২ সালে ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছেন ৩ কোটি ৯১ লাখে। নিরাপদ ও সাশ্রয়ী হওয়ায় প্রতিনিয়ত ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এক সময় এলপিজির খালি সিলিন্ডার আমদানি করা হতো। বর্তমানে দেশের ১৪টি কোম্পানি সিলিন্ডার উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। আরও দুটি কোম্পানি বাজারে আসার অপেক্ষায়। স্থানীয়ভাবে মানসম্মত সিলিন্ডার উৎপাদন করায় আমদানিনির্ভরতা কমেছে। এ খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। বাজারে এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদার বেশিরভাগ স্থানীয় কোম্পানিগুলো জোগান দিচ্ছে।
এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে দেশের এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদার ৬১ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিলিন্ডার থেকে জোগান দিয়েছে, যা ২০২৫ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৩৭ শতাংশে। বর্তমানে ১৪টি কোম্পানির উৎপাদন ক্যাপাসিটি রয়েছে প্রায় এক কোটি ৮ লাখ পিস। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিলিন্ডার চাহিদার বেশিরভাগ জোগান দেয়ার পরও কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। এর একমাত্র কারণ হলো সিলিন্ডার আমদানি। সে জন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আগামী বাজেটে সিলিন্ডার আমদানিতে শুল্ককর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বেসরকারি এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলওএবি)। একই সঙ্গে দেশীয় কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামালের শুল্ককর কমানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
এলওএবির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের বাজার ছিল ৫৬ লাখ ২০ হাজার, যা ২০২২ সালে ৩ কোটি ৯১ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আট বছরে সিলিন্ডার উৎপাদন বেড়েছে তিন কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার। প্রতি বছর চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে এলপিজি সিলিন্ডারের উৎপাদন জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ২০১৬ সালে উৎপাদন হয়েছে ৮৭ লাখ ৩০ হাজার, ২০১৭ সালে এক কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার, ২০১৮ সালে এক কোটি ৯৪ লাখ ১৬ হাজার, ২০১৯ সালে দুই কোটি ৪১ লাখ ৭৭ হাজার ৮০০, ২০২০ সালে তিন কোটি ১৪ লাখ ২১ হাজার ৭৮২ ও ২০২১ সালে তিন কোটি ৪৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৫৭টি।
হিসাবে দেখা গেছে, বর্তমানে ১৪টি কোম্পানি স্টিল এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদন ও বাজারজাত করে। এর মধ্যে রয়েছেÑবসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেড, ওমেরা সিলিন্ডার্স লিমিটেড, টি কে গ্যাস সিলিন্ডার্স লিমিটেড, যমুনা স্পেসটেক জয়েন্ট ভেঞ্চার লিমিটেড, ইউনিটেক্স এলপিজি সিলিন্ডার লিমিটেড, ফ্রেশ এলপিজি লিমিটেড, বিন হাবিব, পেট্রোম্যাক্স সিলিন্ডার লিমিটেড, জি গ্যাস লিমিটেড, নাভানা এলপিজি লিমিটেড, ইউনিভার্সেল এলপিজি লিমিটেড, বিএম এলপিজি লিমিটেড, জেএমআই সিলিন্ডার্স লিমিটেড ও ডেল্টা এলপিজি লিমিটেড। এছাড়া সিটি গ্রুপ ও টিএমএসএস এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদন ও বাজারজাত করার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে বেক্সিমকো একমাত্র কোম্পানি, যারা কম্পোজিট সিলিন্ডার আমদানি করে বাজারজাত করে আসছে।
আরও দেখা গেছে, ১৪টি কোম্পানির বর্তমানে সিলিন্ডার উৎপাদন ক্যাপাসিটি এক কোটি ৮ লাখ ৪৮ হাজার। উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেড। এ কোম্পানির ১৪ লাখ ২০ হাজার সিলিন্ডার উৎপাদনের ক্যাপাসিটি রয়েছে। এছাড়া ওমেরার ৬ লাখ ২৪ হাজার, টি কে গ্যাস ৭ লাখ ২০ হাজার, যমুনা ৫ লাখ ৭৬ হাজার, ইউনিটেক্স ৮ লাখ ১৬ হাজার, জেএমআই ১২ লাখ, ফ্রেশ ১২ লাখ, ডেল্টা ৬ লাখ ২৪ হাজার, পেট্রোম্যাক্স ১০ লাখ ৫৬ হাজার, জি গ্যাস ১০ লাখ ৫৬ হাজার, নাভানা ৪ লাখ ৮০ হাজার, ইউনিভার্সেল ২ লাখ ৮৮ হাজার, বিএম এলপিজি ৫ লাখ ও বিন হাবিবের ২ লাখ ৮৮ হাজার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
অপরদিকে স্থানীয়ভাবে এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদন হওয়ায় আমদানির পরিমাণ কমেছে। ২০১৬ সালে যেখানে ২০ লাখ সিলিন্ডার আমদানি হয়েছে, সেখানে ২০২২ সালে আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৫৩ হাজার ১৪৫টিতে। এছাড়া ২০১৭ সালে ৩৮ লাখ, ২০১৮ সালে ২৫ লাখ, ২০১৯ সালে ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ২৪৫, ২০২০ সালে ১১ লাখ ৪৯ হাজার ৯২ ও ২০২১ সালে ৪ লাখ ১৮ হাজার ২২টি সিলিন্ডার আমদানি হয়েছে। এলওএলবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাজারে এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদার ৬১ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৮ সালে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়েছে ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার পিস। এর মধ্যে ৩৮ লাখ ৬৬ হাজার বা ৬১ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে বাজারজাত করার ক্যাপাসিটি ছিল। প্রতি বছর নতুন এলপিজি সিলিন্ডার বাজারে প্রবেশ করায় উৎপাদন কমেছে। ২০২৫ সালে উৎপাদন হবে এক কোটি ৩২ লাখ ৪৮ হাজার পিস। এ সময় স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হবে ৫০ লাখ পিস সিলিন্ডার। অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে চাহিদার ৩৭ শতাংশ সিলিন্ডার উৎপাদন করে জোগান দেয়া হবে। এছাড়া ২০১৯ সালে ৫৩ শতাংশ, ২০২০ সালে ৫৬ শতাংশ, ২০২১ সালে ২৩ শতাংশ, ২০২২ সালে ৪১ শতাংশ জোগান দেয়া হয়। চলতি ২০২৩ সালে ৪১ শতাংশ, ২০২৪ সালে ৩৬ শতাংশ ও ২০২৫ সালে ৩৭ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিলিন্ডার চাহিদার জোগান দেবে।
এলওএবির পক্ষ থেকে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে আমদানি করা এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ওপর শুল্ককর বাড়ানো ও সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামালের শুল্ককর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী সই করা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশের সীমিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ক্রমান্বয়ে নির্ভরতা কমিয়ে মানসম্মত সিলিন্ডারের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে সর্বশ্রেণির গ্রাহকের কাছে দেশের পরিবেশবান্ধব এলপি গ্যাসের ব্যবহার জনপ্রিয় করতে সরকার কাজ করছে। দেশে জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখছে। সিলিন্ডারের গুণগতমান অক্ষুণœ রেখে এবং নিরাপত্তা বিধান করে ঝুঁকিমুক্ত সিলিন্ডার সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে। দেশীয় সিলিন্ডার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করছে। দেশীয় সিলিন্ডার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখা, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির স্বার্থে আমদানি করা এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ওপর শুল্কহার বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমানে এলপি গ্যাসের ৫ হাজার লিটারের নিচের ধারণক্ষমতার সিলিন্ডারের আমদানিতে মোট শুল্ককর রয়েছে ৩০ শতাংশ। যার মধ্যে রয়েছেÑ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর। বাজেটে সিলিন্ডার আমদানিতে মোট শুল্ককর ৫৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ভ্যাট, অগ্রিম কর ও অগ্রিম আয়কর অপরিবর্তিত রেখে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্কারোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহƒত জিংক ওয়্যারের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ, মিগ ওয়্যারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়।