৫ আগস্ট জনতার বিজয় শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

স্বাধীনতার পর ঘটে গেল আরেকটি জনবিস্ফোরণ। জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ৫ আগস্ট, ২০২৪। ১৯৯০ সালে অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার রেকর্ডটি এখন শেখ হাসিনার। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত হাসিনার মতো কেউ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তাই প্রবল প্রতাপ ও দম্ভের স্বর ছিল হাসিনার প্রতিটি কথায়। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থাটা ছিল মেধাবীদের জন্য বড় বাধা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র সরকারি চাকরির ২০ শতাংশ ছিল মেধাবীদের জন্য, বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ এবং ৫০ শতাংশ ছিল জেলা ও উপজাতি কোটার জন্য বরাদ্দ।

রেল, পোস্ট অফিস, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ছিল পোষ্য কোটা ব্যবস্থা, তাই মেধাবীদের চাকরিতে প্রবেশপথটিও ছিল রুদ্ধ। এই জটিল কোটা ব্যবস্থার কারণে প্রকৃত মেধাবীরা চাকরি পেত না। কোটা ব্যবস্থার এই বৈষম্য নিরোধকল্পে ছাত্র আন্দোলন শুরু ২০১৮ সালে। ওই সময়কার সরকার এক প্রজ্ঞাপনে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে প্রবেশের বিষয়ে কোটা ব্যবস্থাটা বাতিল করে। তবে এই বাতিল আদেশের স্বচ্ছতা ও প্রায়োগিকতার বিষয়টি ছিল অস্পষ্ট। এ কারণে কোটা সুবিধাভোগীরা আদালতে একটি মামলা করেন।

আদালতের এক আদেশে সরকারের প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে দেয়া হয়। তারপর সরকার উচ্চ আদালতে আপিল করে। আবার ২০২৪ সালে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলন। তবে দাম্ভিক শেখ হাসিনা সরকার আন্দোলনটিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। শেখ হাসিনা তার দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে মাঠে নামায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনটিকে দমন করতে। অনেকটা চর দখল প্রক্রিয়ার মতো করে মাঠে নামে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দমন প্রক্রিয়াটা ছিল অগণতান্ত্রিক। পুলিশি সহায়তায় ছাত্রলীগ কর্মীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। এর ফলে আন্দোলনটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। একপর্যায়ে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি মাঠে নামে। শুরু হয় দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয় সরকার।

তবে ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাস ছাড়তে রাজি হননি, তারা হলে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর তখনই ছাত্র-ছাত্রীদের হলে হামলা চালায় র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারের এই ঘৃণ্য নির্দেশ পালন করতে গিয়ে জনরোষে পড়েছে দেশের পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির মত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা। সরকারি সব বাহিনী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে চাপে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা ঢাকায় প্রবেশ করে। সেনাবাহিনীসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্তম্ভিত হয়ে যায় ছাত্র-জনতার স্রোতধারাটি দেখে। ৫ আগস্ট বেলা ২টায় শেখ হাসিনা বিশেষ বিমানযোগে ভারত পালিয়ে যান। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে কত প্রাণ ঝরেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যন এখনও পাওয়া যায়নি। এই আন্দোলনটির মূল্য উদ্দেশ্য কী ছিল সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর তথাকথিত গণতন্ত্রের জš§ নেয়। এই তথাকথিত গণতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। ফলে সরকারি প্রশাসন হয়ে যায় দলদাসে। এই দলদাসদের বিরুদ্ধে জনতা ফুসে ওঠে। সেজন্য সংগঠিত হয় ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লব।

জনতার রোষানল থেকে রক্ষা পেতে প্রায় পাঁচ দিন পুলিশের সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তারা পোশাক ছেড়ে নিজ নিজ ঘরে ঢুকে যান। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, প্রোভিসি ও প্রক্টররা পরিণত হয়েছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মীতে। ডিবিপ্রধান হারুন টক অব দ্য কান্ট্রি। কারা এই হারুনদের জš§ দিয়েছে, তা আজ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এরকম দাস হারুন প্রশাসনসহ সর্বস্তরে সৃষ্টি হয়। প্রশাসনের ওসি, ইউএনও, ডিসি, এসপি ও সচিবরা সরাসরি যুক্ত হয়ে যান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমে।

প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধিদের কথা শুনতেন না। কারণ ভোটারবিহীন নির্বাচনে প্রশাসনিক আমলা ও পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় নির্বাচিত হয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র, কাউন্সিল নির্বাচিত হতেন রাতের ভোটে, আর রাতের ভোটকর্মটি সম্পন্ন করতেন প্রশাসনে কর্মরতরা। তাই প্রশাসনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ছিল না কোনো জনপ্রতিনিধির। ফলে ডিবি হারুন ও বেনজীররা হয়ে ওঠেন দুর্দমনীয় প্রতাপশালী হিসেবে। তাদের জবাবদিহি করতে হতো না। যোগ্যতাহীন ব্যক্তিদের আখড়ায় পরিণত হয় মন্ত্রিসভাসহ প্রশাসন।

তেলমর্দনের বিনিময়ে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হন প্রশাসনের কর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। অযোগ্য ব্যক্তিরা অধিষ্ঠিত হন ক্ষমতার আসনে, তাই তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। বিরুদ্ধাচরণকারী ও সমালোচকদের দমন করতে তারা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে সৃষ্টি হয় আয়নাঘর, আর দ্বিমত পোষণকারীদের দমন করতে চালানো হয় গুম, খুন ও লুটপাট। তাছাড়া তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট দাবি করেন। কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষের চেতনায় ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে মিশে আছে। তাই সস্তায় জনপ্রিয়তা লাভের আশায় এবং জনগণকে নিজেদের পাশে রাখার জন্য হাসিনা সরকার তার সমালোচকদের ও দ্বিমত পোষণকারীদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দেয়।

আওয়ামী শাসকচক্রের দুর্নীতি গগনচুম্বী হয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতি করার জন্য তারা গড়ে তোলেন ব্যবসা-বাণিজ্য, সিন্ডিকেটসহ টেন্ডার বাণিজ্য। শুধু রাজশাহী সিটি করপোরেশনে গত সাত বছরে এলটিএম টেন্ডার হয়নি একটিও। অথচ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার টেন্ডারের ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন মেয়র লিটন ও তার সহযোগীরা চক্ররা। এ রকম লাখ লাখ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে নেয় আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী। সরকারি চাকরিতে প্রবেশ এবং পদোন্নতিসহ সব ক্ষেত্রে আওয়ামীকরণ করা হয়। সরকারি অফিস-আদালতে চলে অবাধে ঘুষ। এ ধরনের অনিয়মের বিষয়গুলো জনতা বুঝতে পারে। তবে জনগণ তার প্রতিবাদ করার মতো কোনো প্ল্যাটফরম পায়নি। যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখন সাধারণ মানুষ আন্দোলনটিকে সমর্থন জানায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে একটি বিষয় প্রমাণিত হয়ে যায় যে, এ দেশের মানুষ বিদ্যমান রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে পছন্দ করে না।

কারণ শেখ হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো নানা কার্যক্রম করলেও ওই সব কার্যক্রমে সাধারণ মানুষের বিশেষ কোনো সমর্থন ছিল না। তার কারণ বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সাধারণ জনতা আস্থা রাখতে পারেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর যখন শেখ হাসিনার সরকার গুলি চালায়, তখন মানুষের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার চিত্রটা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। দেখা যায়, সাধারণ মানুষ কাতারে কাতারে নেমে আসে ছাত্রদের পক্ষে। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়টি ছিল না। তাই শুরু হয়ে যায় ছাত্র-জনতার তীব্র প্রতিরোধ। এই তীব্র প্রতিরোধের মুখে হাসিনার প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়ে। হাজার হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য জনতার ঢল দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন। তাদের হাতের অস্ত্র থেমে যায়। জনরোষ থেকে শেখ হাসিনা নিজেকে বাঁচাতে দুপুরে খাবার না খেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ভারত পালিয়ে যায়।

চলে আসে ছাত্র-জনতার বিজয়। তারপর হঠাৎ করে দেখা যায় কতিপয় রাজনৈতিক দল এই বিজয়কে নিজেদের রাজনৈতিক বিজয় বলে দাবি করে। তারা বিজয় মিছিল বের করে। আর তখনই বিজয় আনন্দে বেজে ওঠে বিষাদের নিনাদ। দেশের গণভবন, জাতীয় সংসদসহ সারাদেশে শুরু হয় অবাধে লুটতরাজ। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট হয়ে যায়। রাজশাহীর নগর ভাবনসহ দেশের পুলিশ স্টেশন, সরকারি অফিস-আদালত, বিলাসবহুল মাকের্টসহ সব স্থানে দুর্বৃত্তরা চালায় অবাধ লুণ্ঠন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সারাদেশে হাজার কোটি টাকার মতো সম্পদ লুণ্ঠিত হয়, যা ১৯৭১ সালের পাক হানাদারদের লুটতরাজকে হার মানিয়েছে। কারণ দুর্বৃত্তরা হামলা চালায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, হিন্দু, বৌদ্ধ ও আদিবাসীদের উপসনালয় এবং নানা স্থাপনায়। ময়মনসিংহে জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য ও শশী লজের স্নানরত ভেনাস দেবীর ভার্স্কযটি ধ্বংস করে ফেলে। রাজশাহীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছিল আইএসের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে দেশে।

প্রকৃতার্থে ছাত্র-জনতা কি এমনটি চেয়েছিল? হামলা ও লুটতরাজে প্রমাণিত হয়ে যায়, রাজনৈতিক দলগুলো প্রকৃতপক্ষেই জনগণের মঙ্গল চায় না। কারণ বিশাল জনতার আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক রূপ নেয়ার পর-পরই শুরু হয় লুটপাট। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে শেখ হাসিনার চেয়ে দ্বিগুণ লুটেরা হয়ে যাবে। মন্তব্য করার কারণ হলো, দুর্বৃত্তরাই নিজেরাই বলেছে, ‘আওয়ামী লীগের পাণ্ডারা ১৫ বছরে অনেক কামিয়েছে, এখন আমরা কিছু কামাই।’

বারবার রক্ত দিয়ে লুটেরা, ধর্মান্ধ ও স্বৈরশাসকদের এদেশ থেকে হটানো হয়েছে। তারপরও দেখা যায় ভিন্ন রূপ ধারণ করা স্বৈরাচার। এক স্বৈরাচার পালানোর পর জš§ নেয় আরেকটি স্বৈরাচার। তাই স্বৈরাচার নিরোধের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। স্বৈরাচারের বীজটি সমূলে ধ্বংস করতে হবে।
বর্তমানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের এমন একটি ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে আর কখনও স্বৈরাচার ও লুটেরারা ক্ষমতায় আসতে না পারে। আর কেউ যেন ক্ষমতায় গিয়ে স্বৈরাচার হতে না পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০