৫ বছরে পিডিবির লোকসান ১৪,৩৩৭ কোটি টাকা!

চাহিদা না থাকলেও ২০১৭ সালে জরুরি ভিত্তিতে ছয়টি বড় ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন করে সরকার। এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার এসব কেন্দ্র বেশিরভাগ সময়ই বসে থাকত। পাঁচ বছর মেয়াদি এসব উচ্চ ব্যয়ের কেন্দ্রে সরকারের গচ্চা গেছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ কেন্দ্রগুলো নিয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। আজ থাকছে এ নিয়ে ধারাবাহিকের শেষ পর্ব

ইসমাইল আলী: প্রয়োজন না থাকলেও পাঁচ বছরের জন্য ডিজেলভিত্তিক ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল ২০১৭ সালে। এতে এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বছরের বেশিরভাগ সময় বসেই থাকত। নির্ধারিত মেয়াদে (৬০ মাস) মাত্র ১১ শতাংশ চললেও চুক্তির কারণে শতভাগ ক্যাপাসিটি চার্জই পরিশোধ করতে হয়েছে। এর প্রভাবে কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়। ফলে ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কিনে পাঁচ বছরে বিপুল লোকসান গুনেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাঁচ বছরে ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৫২ টাকা ৪৮ পয়সা। তবে এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে গড়ে পিডিবি পেয়েছে মাত্র পাঁচ টাকা ৪০ পয়সা।

অর্থাৎ ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কিনে প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে ৪৭ টাকা ৮ পয়সা। এতে ৬০ মাসে ছয় কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে পিডিবি লোকসান গুনেছে ১৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
পিডিবির কর্মমর্তারা জানান, রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ গচ্চা গেলেও কুইক আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) নামক এসব কেন্দ্র ছিল মূলত বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কুইক (দ্রুত) অর্থ বানানোর হাতিয়ার। যদিও এগুলোর যন্ত্রপাতি বেশিরভাগ ছিল নিম্নমানের। ফলে সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার হলে উল্টো জরিমানা দিতে হতো। এছাড়া পুরোনো যন্ত্রপাতি কিনে বাংলা ট্র্যাকের মালিক অর্থ পাচার করেছে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, বাংলাক্যাট গ্রুপের মালিকানাধীন বাংলা ট্র্যাক (প্রথম ইউনিট) ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পাঁচ বছরে উৎপাদন হয়েছে ৫২ কোটি ২২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৯৫৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তবে এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি পেয়েছে মাত্র ২৮১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে বাংলা ট্র্যাক (প্রথম ইউনিট) কেন্দ্রটিতে পিডিবির লোকসান হয়েছে দুই হাজার ৬৭৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয় ১১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। পরের দুই অর্থবছর লোকসান হয় যথাক্রমে ৩৫৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ও ৩৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। যদিও চুক্তির শেষ দুই বছর তা লাফিয়ে বাড়ে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসান হয় ৫৯২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৭৯৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী ছিল বাংলা ট্র্যাক ১০০ মেগাওয়াট (দ্বিতীয় ইউনিট) কেন্দ্রটি। পাঁচ বছরে এ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৫৪ কোটি ৬২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয় এক হাজার ৯৫৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি পেয়েছে ২৭৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে বাংলা ট্র্যাক (দ্বিতীয় ইউনিট) কেন্দ্রটিতে পিডিবির লোকসান হয় এক হাজার ৬৭৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনে ৮১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা এক লাফে বেড়ে হয় ৩১৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। পরের চার অর্থবছরই লোকসান ওঠানামা করে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছর লোকসান হয় ২৭০ কোটি ৭৪ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছর ৩২২ কোটি ৬৩ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছর ৩১৭ কোটি ৭৯ লাখ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৩৬৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
পিডিবির তথ্যমতে, এগ্রিকো এনার্জি সল্যুশন লিমিটেড (ওরাহাটি) ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৩৯ কোটি ৪৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৮১১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এ বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি পেয়েছে ২১৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে এগ্রিকো এনার্জি সল্যুশন কেন্দ্রটিতে পিডিবির লোকসান হয় এক হাজার ৫৯৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনে মাত্র ১০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা এক লাফে বেড়ে হয় ২২৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর লোকসান আবার কমে দাঁড়ায় ১৮২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। পরে তা আবার বেড়ে যায়। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছর লোকসান হয় ২১৮ কোটি ৭৯ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছর ৩৭৪ কোটি ৭২ লাখ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫৮৪ কোটি ১০ লাখ টাকা।

এদিকে এগ্রিকো পাওয়ার সল্যুশন (ব্রাহ্মণগাঁও) লিমিটেড ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিতে পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৩৪ কোটি ৩৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট ব্যয় ছিল এক হাজার ৬৮৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। তবে সে বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি আয় করেছে মাত্র ১৮৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে এগ্রিকো পাওয়ার সল্যুশন কেন্দ্রটিতে পিডিবি লোকসান গুনেছে এক হাজার ৪৯৮ কোটি চার লাখ টাকা।

এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনে মাত্র ৩২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা এক লাফে বেড়ে হয় ২০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর লোকসান হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৮২ কোটি টাকা। পরের বছরগুলো তা আবার বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছর লোকসান হয় ২০১ কোটি ৮৮ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছর ৩৬৩ কোটি ১৯ লাখ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫১১ কোটি দুই লাখ টাকা।

৬০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পানগাঁওয়ে নির্মিত ৩০০ মেগাওয়াট এপিআর এনার্জি বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পিডিবির সবচেয়ে বেশি লোকসান হয়েছে। পাঁচ বছরে এ কেন্দ্রে উৎপাদন হয়েছে ৯২ কোটি ৩৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে মোট ব্যয় হয় চার হাজার ৮৯৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। সে বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি আয় করেছে মাত্র ৫০৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে এপিআর এনার্জি কেন্দ্রটিতে পিডিবি লোকসান গুনেছে চার হাজার ৩৯২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনে মাত্র ২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা এক লাফে ১৯ গুনের বেশি বৃদ্ধি পাায়। ওই অর্থবছর এপিআর এনার্জির বিদ্যুৎ কিনে পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৫৬৮ কোটি ১২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর লোকসান দাঁড়ায় ৫৩৯ কোটি ৫৭ লাখ ও ২০২০-২১ অর্থবছর ৬০৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসান বেড়ে হয় ৯৫১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছর তা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছর কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে লোকসান গুনতে হয় এক হাজার ৭০০ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

অন্যদিকে ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে কম চলে প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি। ২০১৮-১৯ অর্থবছর চালু হওয়া ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটিতে পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৩১ কোটি ৩৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৬৭১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সে বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি আয় করেছে মাত্র ১৭৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি কেন্দ্রটিতে পিডিবি লোকসান গুনেছে চার হাজার ৩৯২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রথম বছর (২০১৮-১৯ অর্থবছর) পিডিবি লোকসান গুনে ১৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫২ কোটি ৮৮ লাখ ও ২০২০-২১ অর্থবছর ৩৭৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসান আরও বেড়ে হয় ৫২৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৭৩৯ কোটি ছয় লাখ টাকা। আর বিদায়ী অর্থবছর লোকসান হয়েছে ৩৪৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

সব মিলিয়ে পাঁচ বছর তথা ৬০ মাস ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৩০৪ কোটি ৪৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয় ১৫ হাজার ৯৮০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সে বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি আয় করেছে মাত্র এক হাজার ৬৪২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ছয় কেন্দ্রে পিডিবি লোকসান গুনেছে ১৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

এ সময়ের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছর ছিল সর্বোচ্চ লোকসান চার হাজার ৭০০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসান হয় তিন হাজার ১২৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর দুই হাজার ১২২ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর এক হাজার ৮৮৭ কোটি ৬৫ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছর এক হাজার ৮৮৬ কোটি চার লাখ টাকা ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২৬৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছর লোকসান হয়েছে ৩৪৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

আর পড়ুন (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় সাড়ে ৫২ টাকা!

আর পড়ুন (প্রথম পর্ব)
বসিয়ে রেখেই ক্যাপাসিটি চার্জ ৯৪০০ কোটি টাকা!

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০