ইসমাইল আলী: নির্মাণশেষে এক বছর পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর পরের পাঁচ বছর এমবিইসির সঙ্গে যৌথভাবে এ কাজ করবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি)। পাশাপাশি সেতুটির টোল আদায়ের দায়িত্বও প্রতিষ্ঠান দুটির। এজন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে (বিবিএ) পাঁচ বছরে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৬৯৩ কোটি টাকা।
যদিও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের ৩৮ শতাংশেরও বেশি যাবে দুই কোম্পানির কর্মীদের বেতন-ভাতায়। আর অটোমেটিক টোল কালেকশন সিস্টেম (ইটিসি) স্থাপনে ব্যয় হবে আরও ২২ শতাংশ অর্থ। অর্থাৎ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের ৬০ শতাংশ দুই খাতেই ব্যয় হয়ে যাবে।
সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গত এপ্রিলে পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের অপারেটর নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এতে পাঁচ বছরের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯২ কোটি কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতা বাবদই ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর ইটিসি স্থাপনে ব্যয় হবে ১৫৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অথচ মূল সেতু রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হবে মাত্র ৩২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা এবং নদীশাসনে ১৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
এর বাইরে দুই দিকের সংযোগ সড়কের রক্ষণাবেক্ষণে সাত কোটি টাকা, তিনটি সার্ভিস এরিয়া রক্ষণাবেক্ষণে ১৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, টোল প্লাজা রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ কোটি টাকা, আইটিএস সেবা রক্ষণাবেক্ষণে আরও প্রায় ছয় কোটি টাকা, গাড়ি ও সরঞ্জাম কেনায় প্রায় ২৬ কোটি টাকা এবং ব্যবস্থাপনা সিস্টেম পরিচালনায় প্রায় আট কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। আর সেতুটির বিমায় যাবে ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা ও পরিষেবা খাতে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বাকি অর্থ প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় করা হবে।
প্রসঙ্গত, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের মধ্যে প্রায় ৪৬৯ কোটি তিন লাখ টাকা দেশীয় মুদ্রায় পরিশোধ করা হবে। বাকিটা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে, যার পরিমাণ প্রায় দুই কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। তবে ডলারের দর পরিবর্তনের ফলে শেষ পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে স্টিলের অবকাঠামোর জন্য পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেশি হবে বলে ২০২০ সালেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, সেতুটি স্টিল অবকাঠামোর হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় তুলনামূলক বেশি হবে, যা প্রকল্পটির দুর্বল দিক।
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রেন চলাচল করেÑএমন সেতুতে কংক্রিটের চেয়ে স্টিলের অবকাঠামোই বেশি উপযুক্ত। কারণ ট্রেন চলাচলে সৃষ্ট কম্পনের ফলে কংক্রিটে ভাঙন সৃষ্টি হয়। এতে সেতুতে দ্রুত ফাটল ধরে, যেমনটি বঙ্গবন্ধু সেতুতে দেখা গিয়েছিল। তবে স্টিলের সেতুতে নাট-বোল্ট দ্রুত ক্ষয় হয়। এজন্য নিয়মিত এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এছাড়া লোহার অন্যতম শত্রু পানি। যেহেতু পানির ওপর সেতু নির্মাণ করা হয়, তাই স্টিলের অবকাঠামোয় দ্রুত জং ধরার ঝুঁকি থাকে। এজন্য সারাবছর ধরে এসব সেতু রং করতে হয়। এজন্য ব্যয়ও বেশি হয়। পাশাপাশি দক্ষ জনবলও দরকার হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশে অন্যতম স্টিলের সেতু হার্ডিঞ্জ রেল সেতু। এটিকে সারাবছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত রং করতে হয়, নাট-বোল্ট ক্ষয় হলে নিয়মিত প্রতিস্থাপন করতে হয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও এ ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত করতে হবে। এজন্য ব্যয় বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ জনবলও দরকার হবে।
দক্ষ জনবলের বিষয়টি আইএমইডির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষকে দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে ডিজাইন লাইফ (১০০ বছর) সময়ে সেতুটি সচল রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন করা হবে পদ্মা সেতু। আর সেতুটিতে যান চলাচল শুরু হবে পরের দিন সকাল থেকে।