ইসমাইল আলী: বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক আসে বেসরকারি খাতের আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকির অর্থ ছাড় বন্ধ রাখায় এ খাতের বিল নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। একই অবস্থা ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ বিলের। এমনকি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নিজস্ব কেন্দ্র ও সরকারি অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের বিলও বকেয়া পড়েছে।
পাশাপাশি বড়পুকুরিয়ার কয়লা ও বিপিসির তেলের বিল জমে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে গৃহীত বিদেশি ঋণের কিস্তি (ডিএসএল) পরিশোধও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচ মাসে পিডিবির বকেয়া পড়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থা চলতে থাকলে পিডিবির পক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য বিদ্যুৎ খাতে তারল্য সংকট হ্রাসে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে পিডিবি।
সম্প্রতি সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, গত মার্চ থেকে ভর্তুকি ছাড় বন্ধ রেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে পিডিবির বকেয়া বেড়েই চলেছে। শুধু সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিলই বকেয়া পড়েছে ৩৪ হাজার ২১২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে মে মাসের বকেয়া বিল তিন হাজার ৬৮৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, জুনের সাত হাজার ১২৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, জুলাই মাসের সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা, আগস্টের সাত হাজার ৮০০ কোটি টাকা ও সেপ্টেম্বরের আট হাজার ১০০ কোটি টাকা।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া পড়েছে এক হাজার ১১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগস্টের বকেয়া ৪৫১ কোটি টাকা ও সেপ্টেম্বরের ৬৬৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। পিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের বকেয়া বিল ৪৩৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জুলাই মাসের বকেয়া ১৪৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা, আগস্টের ১৪৫ কোটি ও সেপ্টেম্বরের ১৪৫ কোটি টাকা। এছাড়া বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিল বকেয়া ১২০ কোটি ও বিপিসির তেলের বিল বকেয়া ২৯৭ কোটি টাকা।
এদিকে বিদ্যুৎ বিলের একটি অংশ বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিলে জমা দিতে হয়। কিন্তু তারল্য সংকট থাকায় পিডিবি তা নিয়মিত জমা দিতে পারছে না। এতে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৮০ কোটি ৯০ লাখ টাকা বকেয়া পড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণের কিস্তিও নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। এতে ডিএসএল বকেয়া পড়েছে ৭০০ কোটি টাকা।
এর বাইরে চার হাজার ৬৮৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে পিডিবির। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ তিন হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের মূল্য আংশিক পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রদেয় উদ্বৃত্ত তহবিলের ৩০০ কোটি টাকা, নর্থওয়েস্ট জোন পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির চলতি মূলধন বাবদ প্রদেয় ২৩২ কোটি টাকা এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাংলাদেশ অংশের ইক্যুইটি বাবদ প্রদেয় ২৫০ কোটি টাকাও রয়েছে।
তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে নেয়া ঋণও রয়েছে ৮৯৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ৭০৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, শাহজিবাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ১০৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং সিলেটের ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ৭৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর পিডিবির স্পেশাল বিজনেস ইউনিট স্থাপনের বিল ও তার শুল্ককর বাবদ বকেয়া পড়েছে ১২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে পাঁচ মাসেই পিডিবির বকেয়া পড়েছে ৪১ হাজার ৯৪৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এতে বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে সংস্থাটি। এর কারণ হিসেবে কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বার্থে ২০১১ সালে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহƒত ফার্নেস অয়েল আমদানির ওপর শুল্ককর অব্যাহতি দিয়েছিল সরকার। তবে ২০২০ সালের জুনে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এতে ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে গিয়ে ১০ শতাংশ শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর ও দুই শতাংশ অগ্রিম আয়কর দেয়া লাগছে।
২৭ শতাংশ শুল্ককর পরিশোধ বাবদ প্রতি বছর ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে। তবে ওই তেল দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিল পিডিবির থেকে কোম্পানিগুলো পেতে চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। এতে কোম্পানিগুলো তারল্য সংকটের মুখে পড়েছে। আর সরকার ভর্তুকি হিসেবে ওই শুল্ককর অর্থ মন্ত্রণালয় পিডিবিকে ফেরত দিচ্ছে সাত থেকে আট মাস পর। এতে পিডিবির তারল্য সংকট ঘনীভূত হয়েছে। এ অবস্থায় ফার্নেস অয়েলের শুল্ককর প্রত্যাহার করলে সরকারের রাজস্ব ব্যয় ও ভর্তুকি হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও কমবে। ফলে পিডিবির লোকসানের বোঝা কমবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ৫২এন ধারা ২০২১ সালে সংশোধন করে পিডিবির ওপর ছয় শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে। এতে পিডিবির লোকসান ও তারল্য সংকট অনেক বেড়ে গেছে। সাধারণত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ওপর ২৫ শতাংশ করারোপ করা হয়। আর লোকাসানি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করা হয়।
পিডিবি লোকসানি সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও ছয় শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে। অথচ পেট্রোবাংলার ওপর শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হয়। তবে পিডিবির ওপর অধিক হারে উৎসে কর আরোপের ফলে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতেও পিডিবির তারল্য সংকট বেড়ে গেছে। তাই পিডিবির উৎস কর হ্রাস করে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ করা যেতে পারে।