রোহান রাজিব: ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান বেড়েই চলছে। ৩ শতাংশের নিচে থাকা সুদহারের ব্যবধান এখন ৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক ঋণ ও আমানতের ব্যবধান বা স্প্রেড ৫ দশমিক ০৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা তার আগের মাসে ছিল ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, গত জুলাই থেকে ৯-৬ সুদহারের সীমা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ধীরে ধীরে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়েছে। বর্তমানে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে ঋণের সুদহার। ঋণের সুদহার বৃদ্ধিতে ব্যাংকগুলো আমানতেরও সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান বেড়েছে। স্প্রেড বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফাও বৃদ্ধি পাবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলো গড়ে ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ সুদে আমানত নিয়েছে। বিপরীতে ঋণ বিতরণ করেছে গড়ে ৭ দশমিক ২৭ শতাংশ সুদে। এতে ব্যাংক খাতের ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ছিল ২ দশমিক ৯৬ শতাংশে।
চলতি বছরের একই সময়ে ব্যাংকগুলো গড়ে ৫ দশমিক ০১ শতাংশ সুদে আমানত নিয়েছে। এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ করেছে গড়ে ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ সুদে। এতে ব্যাংক খাতের ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ছিল ৫ দশমিক ০৪ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে স্প্রেড বেড়েছে ২ দশমিক ০৮ শতাংশ।
আর গত বছরের জুলাইয়ের পর থেকে স্প্রেড বেড়েছে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত জুলাইয়ে ঋণ ও আমানতের স্প্রেড ছিল ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ঋণ ও আমানতের ব্যবধান বৃদ্ধি ব্যাংক খাতের জন্য ভালো। এক সময় স্প্রেডটা ৪ শতাংশ ছিল, তা এখন অনেক কমে গেছে। স্প্রেড কমা ব্যাংক খাতের জন্য ভালো দিক নয়। ব্যাংকের টেকসইনির্ভর করে মার্জিনের ওপর। কোর ব্যবসা কিন্তু টাকা দেয়া ও টাকা নেয়া। মার্জিন কমতে থাকলে সেটা টেকসই হয় না। স্প্রেড এখন ধারাবাহিকভাবে বাড়তেছে, কারণ গত জুলাই থেকে নতুন সুদহার চালু হয়েছে। একটা ব্যাংকের টেকসই অবস্থান বুঝাতে হলে ভালো মার্জিন থাকা দরকার।
আমানতের চেয়ে ঋণের সুদহার দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, সাধারণত ব্যাংকের ঋণের সুদহারই সবসময় আগে বাড়ে। এরপর আমানতের সুদহার বাড়ে। কারণ প্রতিযোগিতার বাজারে যে যত কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা করতে পারবে, সে-ই লাভবান।
গত দুই বছর ধরে দেশে চড়া মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। এতে গত অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে।
চলতি অর্থবছর থেকে ঋণের সুদহার ব্যাপকভাবে বাড়ানো শুরু হয়েছে। আমানতের সুদহার বাড়তে শুরু করেছে গত অক্টোবর থেকে। ওই সময়ে ঋণের সুদহার যেভাবে বেড়েছে, ওই গতিতে আমানতের সুদহার বাড়েনি।
গত জুলাই থেকে ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের জন্য করিডোর আরোপ করেছে। এতে ঋণের সুদহার বাড়ানোর পদ্ধতি থাকলেও ব্যাংকের আমানতের সুদহার সমন্বয়ের কোনো পদ্ধতি নেই। ফলে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদামতো আমানতের সুদহার বাড়াচ্ছে। এতে আমানতের সুদহার বেড়েছে অনেক কম।
সাম্প্রতিক সমন্বয়ের পরও মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে আমানতের গড় সুদহার অনেক নিচে রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৬৬ শতাংশ। ওই সময়ে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৫.০১ শতাংশ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হারের প্রায় অর্ধেক ছিল আমানতের সুদহার।
ফলে ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন টাকার ক্ষয় বেশি হচ্ছে। এতেও গ্রাহকরা ব্যাংকে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। সে কারণে আমানত প্রবৃদ্ধির হার খুবই কম।
যদিও ব্যাংকগুলোকে দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের নভেম্বরে সুদহারের স্প্রেড ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার সীমাবদ্ধতা উঠিয়ে দিয়েছে। কারণ ঋণের সুদহার স্মার্ট রেটের (সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অভ ট্রেজারি বিল) সঙ্গে যুক্ত থাকে।
স্প্রেড সীমা তুলে না দিলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কারণ স্প্রেড সীমাবদ্ধতা থাকলে যেসব ব্যাংক কম সুদে আমানত নিতে পারবে, তারা চাইলেও বেশি সুদে বিনিয়োগ করতে পারবে না। সেই চিন্তা করে সুদহারের স্প্রেড ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার সীমাবদ্ধতা তুলে দেয়া হয়েছে।