Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:32 am

৬১টি ব্যাংকের ৪২টিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে

রোহান রাজিব : ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। নানা ধরনের ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪২টি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তিন মাসে ৪২ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। একসঙ্গে এত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এর আগে কখনও হয়নি বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও দেশের অর্থনীতিবিদরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে নানা কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ চাপে আছে। আবার কিছু কিছু ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারেনি। কিছু ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল করার পর আবার খেলাপি হয়েছে। তাই ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। যদিও মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের এক লাখ এক হাজার ৩১৫ কোটি টাকাই শীর্ষ ১০ ব্যাংকে রয়েছে।

সরকারি পাঁচ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে: গত জুন শেষে রাষ্ট্রায়াত্ত ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ০১ শতাংশ, মার্চ শেষে যা ছিল ৫৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত তিন মাসে রাষ্ট্রায়াত্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে জনতা ব্যাংকে। গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। জুনে ১৩ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরপর অগ্রণী ব্যাংকে তিন মাসে এক হাজার ৫৫২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪৯৫ কোটি বা ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। এছাড়া তিন মাসে বেসিক ব্যাংকের ৫৫০ কোটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২৫ কোটি বা ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাকিদের খেলাপির হার ২০ শতাংশের কম।

বেসরকারি ২৯ ব্যাংকে বেড়েছে খেলাপি: গত জুন শেষ বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকের খেলপি ঋণ বেড়েছে সাত হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত তিন মাসে বেসরকারি ৪৩টি ব্যাংকের মধ্যে ২৯টি ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ওয়ান ব্যাংকে ৫৮৪ কোটি বেড়ে খেলাপি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮৩১ কোটি বা ১৩ দশমিক ০৯ শতাংশ, আইএফআইসিতে ৪৭২ কোটি বেড়ে হয় দুই হাজার ৭৬৭ কোটি বা ৭ দশমিক ২১ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংকে ৩৪৪ কোটি বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৩৭১ কোটি বা ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ, ডাচ্-বাংলাতে ২৯৬ কোটি বেড়ে হয় দুই হাজার ১২৫ কোটি বা ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং ইউসিবিতে ২৯৩ কোটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১০০ কোটি বা ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

অন্যদিকে প্রিমিয়ার ব্যাংকে ২৮৩ কোটি বেড়ে জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৭৯ কোটি বা ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া পদ্মা ব্যাংকে তিন মাসে ২৪৩ কোটি, উত্তরা ব্যাংকে ১৪১ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৬৭ কোটি, ঢাকা ব্যাংকে ৬০ কোটি, মেঘণা ব্যাংকে ৪৮ কোটি, মিচুউয়াল ট্রাস্টে ৪৪ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংকে ৩৮ কোটি, মধুমতীতে ২৫ কোটি, কমিউনিটি ব্যাংকে ২১ কোটি ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে এক কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

বিদেশি ছয় ব্যাংকে বেড়েছে খেলাপি: গত জুন শেষে বিদেশি ৯ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল তিন হাজার ১৯৭ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা মার্চে ছিল তিন হাজার ৪২ কোটি বা ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসে এসব ব্যাংকে ১৫৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসে বিদেশি ৯ ব্যাংকের মধ্যে ছয়টিতেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন মাসে ব্যাংক আল ফালাহ্র খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক কোটি এবং কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনে সামান্য বেড়ে ৬৩ দশমিক ১০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনে (এইচএসবিসি) ১৩৩ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে দুই কোটি, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে চার কোটি এবং উরি ব্যাংকে ৩৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের দুটিতে খেলাপি বেড়েছে

জুন শেষ বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা গত মার্চ শেষ ছিল ৪ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ। তিন মাসে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩১ কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ১২ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ডলারের সংকট কাটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নিচ্ছে সরকার। এ ঋণ ঋণপ্রাপ্তির শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়ে রেখেছে, যা হয়নি। কারণ বর্তমানে খেলাপির ঋণের হার ১০ শতাংশের ওপরে। তাই গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকে সঙ্গে খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। কী কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয় পুনঃতফসিলকৃত ঋণগুলো আবার খেলাপি হচ্ছে। তাই খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে বলে জানানো হয়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ব্যাংক খাতের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এজন্য মূলত দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতি। এ রকম যত সুবিধা দেবে ততই খেলাপি ঋণ বাড়বে। পুনঃতফসিল ঋণও এখন খেলাপি হচ্ছে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল পলিসি। পুনঃতফসিল সুবিধা না দিয়ে সরাসরি খেলাপি করার বার্তা দেয়া উচিত ব্যাংকগুলোকে। তা না করে আরও সুবিধা দেয়া হচ্ছে, যার ফলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার বেড়েছে।

তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে খেলাপি হলে ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন সেবা ও ব্যাংকের বিভিন্ন সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি বিমান বা মেট্রোতে চড়তে দেয়া হয় না। তবে বাংলাদেশে তার উল্টো চিত্র। যারা আইনকানুন মানে না, তাদের আরও সুবিধা দেয়া হয়। গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এটা মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। খেলাপি ঋণ কমাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জোর দিতে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বড় কিছু ঋণ পুনঃতফসিলকৃত ঋণের কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তা আবার খেলাপি হয়ে পড়ে, যার কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার অনেকে পুনঃতফসিল করতে চেয়েও পারেনি। অন্য কারণগুলো বিশ্লেষণ করে বের করা হবে।