নিজস্ব প্রতিবেদক: অবেশেষ প্লাজমা প্রতারক আলিফ আহমেদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ৬২ দিন ধরে অবিরাম চেষ্টার পর ২০ আগস্ট বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেন। প্রতারক আলিফ প্লাজমা দেওয়ার নাম করে প্রয়াত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) কবির হোসেন শিকদারের পরিবার থেকে টাকা নেয়। কিন্তু প্লাজমা না দিয়েই মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়।
পরে কমিশনার ড. এসএম হুমায়ুন কবীরের (সাবেক ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার, বর্তমানে ভ্যাট দক্ষিণ কমিশনার হিসেবে কর্মরত) সহায়তায় দু’বার তাকে প্লাজমা দেয়া হয়। কিন্তু ২৮ দিন করোনার সাথে যুদ্ধ করে ১৭ জুলাই রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন।
## সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা কবির শিকদারের সাথে প্রতারণা
## সঠিক সময়ে প্রতারক প্লাজমা দিলে হয়ত বেঁচে যেত কবির শিকদার
## অসংখ্য রোগীর সাথে প্লাজমা নিয়ে প্রতারণা করেছে আলিফ
কমিশনার ড. এসএম হুমায়ুন কবীর এক ফেসবুক স্টাটাসে উল্লেখ করেন, কবির শিকদার ঢাকা কাস্টম হাউসে কর্মরত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৯ জুন করোনা আক্রান্ত হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে রাজধানীর একাধিক হাসপাতালে আইসিইউ-তে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে জরুরিভিত্তিতে ‘প্লাজমা থেরাপি’ দেয়ার প্রয়োজন হলে তার পরিবার এবং সহকর্মীরা প্লাজমার সন্ধানে বিজ্ঞাপন দেন। কবির শিকদার তখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এ সুযোগে একটি প্রতারক চক্র ‘প্লাজমা ডোনেট’ করার অজুহাতে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। এ প্রতারক ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আসা এবং গভীর রাতে হোটেলে অবস্থান করার খরচ বাবদ জরুরি টাকা চাইলে কবির শিকদারের পরিবার দুইবার মোট নয় হাজার টাকা বিকাশে প্রদান করেন।
কমিশনার উল্লেখ করেন, নির্ধারিত সময়ে প্লাজমা ডোনেট করার জন্য মোবাইলে কল করা হলে প্রতারকের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে জরুরিভাবে তার হোটেলে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিলে জানা যায়, এ নামে কোন ব্যক্তি রাতে হোটেলে অবস্থান করেনি। তখনই প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। ততক্ষণে প্লাজমার অভাবে কবির শিকদারের অবস্থার অবনতি হয়। পরবর্তীতে আমি ডি এস মোস্তাফিজুর রহমান এর মাধ্যমে জানতে পেরে দুই ব্যাগ প্লাজমা বিনা পয়সায় জোগাড় করতে সমর্থ হই। যদিও দুর্ভাগ্যবশত: কয়েকদিন পরই কবির শিকদার আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন।
আরো পড়ুন-করোনার কাছে হেরে গেলেন কাস্টমস কর্মকর্তা ‘কবির’ [1]
ড. এসএম হুমায়ুন কবীর বলেন, প্লাজমা ডোনেট করার মত এমন জীবন রক্ষাকারী ও জরুরি মানবিক বিষয় নিয়ে এ ধরণের হীন জঘন্য প্রতারণা মানুষকে হত্যা প্রচেষ্টার সামিল। একজন মুমূর্ষু কাস্টমস কর্মকর্তার সাথে এ ধরণের ‘নিষ্ঠুর প্রতারণা’ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কবির শিকদার এর সহকর্মী সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম-কে দিয়ে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করিয়ে তদন্তের সূত্রপাত করি। তদন্ত কর্মকর্তা, টাকা প্রদানের স্থান, কবির এর মৃত্যুস্থল কোন কিছুই আমার জুরিসডিকশন এর অন্তর্ভুক্ত না।

শুধুমাত্র কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট কো-অপারেটিভ সোসাইটির সমাজকল্যাণ বিষয়ক কমিটির আহবায়ক হিসেবে মামলার কপি সংযুক্ত করে এডিশনাল আইজি, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ বরাবর চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একাধিকবার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করি।
ডিবি পুলিশ এর সহায়তায় অপরাধীর অবস্থান সনাক্ত করে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। কিন্তু অত্যন্ত সুচতুর প্রতারক বিষয়টি টের পেয়ে মোবাইল ফোন একাধারে বন্ধ রাখে ও মোবাইল ফোন একাধিকবার পরিবর্তন করে। প্রতারক মামলার বিষয়টি জানতে পেরে ভিপিএন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যামোফ্লাজ করে বারবার নিজের মোবাইলের অবস্থান, নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের তৎপরতায় ডিবি পুলিশ যৌথভাবে তাকে ট্র্যাক করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে বৃহস্পতিবার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা হতে ডিবি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

তার নাম আলিফ আহমেদ। বাড়ি কুমিল্লায়। বাবা একজন আইনজীবি। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে সে বিবিএ সম্পন্ন করেছে বলে জানিয়েছেন। বর্তমানে সে এ ধরণের বিভিন্ন প্রতারনায় সম্পৃক্ত এবং আরো অনেক রোগির সাথে প্লাজমা বিষয়ক প্রতারণা করে আসছিল। এমনকি পুলিশ গ্রেফতারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একাধিক সিম ব্যবহার করে এ প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিল বলে জানিয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল আমি ব্যক্তিগতভাবে ডিবি অফিসে উপস্থিত হয়ে জেনেছি যে, সে এবং আরও কিছু ব্যক্তি এই চক্রের সাথে জড়িত। এ ধরনের চক্রের সকলকে গ্রেফতার ও পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইনশাল্লাহ।
কমিশনার বলেন, আমার সব সময় মনে হয়, প্লাজমা যথা সময়ে পেলে কবির হয়তো বেঁচে যেত এবং একটি হাসিখুশি পরিবার হঠাৎ করে অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত হত না। করোনা আক্রান্ত একজন মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তির জীবন নিয়ে খেলা করা, নির্মম প্রতারণার মাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া এবং দেশপ্রেমিক রাজস্ব সৈনিক এর সাথে এ ধরণের অপরাধমূলক আচরণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের আইনানুগ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি সহায়তাকারী সকলকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি উল্লেখ করেন, নয় হাজার টাকার প্রতারণা আপাত দৃষ্টিতে একটি ক্ষুদ্র বিষয় হলেও এ ধরণের একটি গ্যাং-কে আইনের আওতায় এনে বিচারের পথ খুলে যাওয়ায় আশা করি বহু মুমূর্ষু রোগী প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। এবং শুল্ক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা করলে আমরা যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনেক হ্রাস পাবে। শুল্ক কর্মকর্তারা অযাচিত হয়রানি থেকে বহুলাংশে পরিত্রাণ পাবেন বলে আমার ধারণা।