Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 4:05 am

৬/৯ সুদহার ও ডলার রেট ধরে রাখা ছিল ভুল নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ভূত সংকটের জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ভুল নীতি’কে দোষারোপ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করে প্রায় এক দশক ধরে জোর করে নির্দিষ্ট বিনিময় ধরে রাখা হয়েছিল। এর ফলে ডলারের বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। একইভাবে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ এবং আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে আটকে রাখা হয়েছিল। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই দুই ‘ভুল নীতি’ দেশের অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করেছে। এখনই যদি বড় ধরনের সংস্কারের পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ও গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা। দেশের অর্থনীতির চলমান সংকট সমাধানে অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে শুরু করেছে সরকার। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার আলোচনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে যান এই দুই অর্থনীতিবিদ। সেখানে তারা এই পরামর্শ দেন বলে জানা গেছে।

তবে এখনই বড় ধরনের সংস্কারে যাচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্বাচনের পর সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে তাদের জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থনীতির নানা সূচক, নীতি উদ্যোগ ও তার প্রভাব নিয়ে একটি উপস্থাপনা দেন প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। সংকট কাটাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, উপস্থাপনায় সেগুলো তুলে ধরা হয়।

তবে সানেমের পক্ষ থেকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে বলা হয় মূল্যস্ফীতিকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাজারভিত্তিক করতে বলা হয়। এখন যে স্মার্ট চালু রয়েছে, তাও পরিপূর্ণ বাজারভিত্তিক নয়। পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করলে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়াও যাবে না। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যত ধরনের টুলস রয়েছে সব ব্যবহার করতে হবে।

এছাড়া মুদ্রার বিনিময় হারও বাজারভিত্তিক করতে হবে। তা না হলে অফিশিয়াল ও আনঅফিশিয়াল ডলার দরে বড় পার্থক্য থেকে যাবে। এক্ষেত্রে বৈধ পন্থার চেয়ে অবৈধ পন্থায় বেশি রেমিট্যান্স পাঠাবে। তখন প্রণোদনা বাড়িয়েও লাভ হবে না। ডলার সংকট থেকেই যাবে। আর শক্ত হাতে অর্থপাচারও দমন করতে হবে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কমাতেও বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে যারা ঋণখেলাপি তাদের কোনো রকম সুবিধা না দেয়ার জন্য বলা হয়।

বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতি একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারা স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে তাদের বলা হয়েছে, এখনই যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে সংকট আরও গভীর হবে।

তিনি আরও বলেন, চলমান ডলার সংকটে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য তাদের বলা হয়। একই সঙ্গে অর্থপাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়। তা না হলে হুন্ডি ব্যবসা রমরমা থাকবে। এতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স দেশে আসবে। যতই প্রণোদনা বাড়ানো হোক। তাই শক্তভাবে অর্থপাচার দমন করতে বলা হয়। এক্ষেত্রে তারা একমত হয়েছেন যে দেশ থেকে বড় ধরনের অর্থপাচার হয়। অর্থপাচার যারা করে তাদের চিহ্নিত করা যায় কি না জানতে চাওয়া হয়। তখন তারা বলেন, অর্থপাচার যারা করেন তাদের কাছে ধারণা আছে। তবে সঠিক তথ্য প্রমাণ না থাকায় কিছু করতে পারছেন না তারা।

সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সুদহারে ছয়-নয় যে নীতি ছিল তা ভুল নীতি ছিল। এখনও যেটা করা হয়েছে, তাও পরিপূর্ণ বাজারভিত্তিক নয়। সে ব্যাপারে আরও বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেয়া হয়। তখন তারা আশ্বস্ত করে বলেন, সুদের হার আরও বাড়বে। কারণ ট্রেজারি বিলের রেট বেড়ে গেছে। 

‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নয়। রাজস্বনীতি বড় ভূমিকা রয়েছে। আমদানিকৃত যেসব পণ্য রয়েছে, ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে দাম বেড়ে গেছে। তাতে যদি কর ছাড় দিত তাহলে মূল্যস্ফীতি এত বাড়ত না। এ বিষয়টি অর্থসচিবকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া বাজারে যে কারসাজি চলে তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়।’

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে ২৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে বলা হয়। পাশাপাশি যারা ঋণ খেলাপি তাদের কোনো ধরনের সুযোগ দেয়া যাবে না তাও বলা হয়। আর বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার ফাঁকে বের হয়ে যায়, তাও শক্ত হাতে দমন করার জন্য বলা হয়।

এ সময়ে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নির্বাচনের আগে বড় ধরনের কোনো সংস্কার নিচ্ছে না। নির্বাচনের পর করা হবে। নির্বাচনের পর খেলাপি ঋণের ব্যাপারেও শক্ত ভূমিকা নেয়া হবে। পাশাপাশি সুদহার ও ডলার দর বাজারভিত্তিক করা হবে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে মতামত পেয়েছেন বলেও জানান গভর্নর।

জানতে চাইলে সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতি পরিবর্তন ছাড়াও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ আমাদের দেশে মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। এ জায়গাগুলোয় আলাদাভাবে কাজ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ব্যাংকের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্স কেনার ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, দীর্ঘ মেয়াদে এটা কাজে আসবে না। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত ডলারের অফিশিয়াল এবং আনঅফিশিয়াল রেটে পার্থক্য থাকবে, ততক্ষণ রেমিটাররা অবৈধ পথেই ডলার পাঠাবেন। এছাড়া একটা শ্রেণি রয়েছে যারা হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসা করে। এই চ্যানেলটা বন্ধ করার জন্য শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় ততক্ষণ ফরেন কারেন্সিতে একটা আশঙ্কা থেকেই যাবে।

এর আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ ও নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গে একই বিষয়ে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।