রোহান রাজিব: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ৩০০টি আসনের বিপরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ মোট দুই হাজার ৭১৬ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। যাচাই-বাছাই শেষে এক হাজার ৯৮৫ প্রার্থী বৈধ ও ৭৩১ প্রার্থী অবৈধ হয়েছেন। মোট অবৈধ প্রার্থীর মধ্যে অন্তত ১১৮ প্রার্থী ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে দুই হাজার ৭১৬ প্রার্থী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি কি না, সে তথ্য ঋণতথ্য ব্যুরো (সিআইবি) থেকে যাচাই-বাছাই করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল সোমবার প্রার্থীদের সিআইবি তথ্য যাচাই-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
আইন অনুযায়ী, ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। তাই মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রার্থীর দেয়া তথ্য মিলিয়ে দেখেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। কোনো প্রার্থী ঋণখেলাপি থাকলে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেয়া হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ঋণখেলাপির কারণে এই ১১৮ প্রার্থীরও মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করবেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। তবে বাতিল হওয়া প্রার্থীরা চাইলে নির্বাচন কমিশনে প্রার্থিতা ফিরে পেতে আপিল করতে পারবেন। আজ মঙ্গলবার থেকে বাতিল করা মনোনয়নপত্র ফিরে পেতে প্রার্থীদের আপিল আবেদন শুরু হবে, যা চলবে আগামী ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আর আপিল শুনানি শুরু হবে আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে, চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, এমন অনেক প্রার্থী ঋণখেলাপির তালিকায় ছিলেন। এর মধ্যে কিছু প্রার্থী ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করে ঋণ নিয়মিত করে ফেলেছেন। অনেকে চেষ্টা করেও তা পারেননি, কারণ কিছু প্রার্থী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন জাল-জালিয়াতের মাধ্যমে। তাই ব্যাংকগুলো চাইলেও এসব ঋণ নিয়মিত করতে পারে না। তাই ওইসব প্রার্থীর ঋণ নিয়মিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রার্থী আটকে গেছেন। তাই তাদের রিপোর্ট সিআইবিতে খারাপ এসেছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আর যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, অন্যথায় প্রার্থী হতে পারেন না। এ কারণে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে উপস্থিত থাকেন। এছাড়া আপিলের শুনানির সময় নির্বাচন কমিশনেও ঋণখেলাপি প্রার্থীদের ঠেকাতে ব্যাংক কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন।
জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা অংশ নেবেন, তাদের খেলাপি ঋণের তথ্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে দেয়ার জন্য গত মঙ্গলবার এক পরিপত্রে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। এফআইডির ওই পরিপত্র গত বৃহস্পতিবার দেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিপত্রে বলা হয়, প্রার্থীদের ঋণখেলাপি তথ্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে দিতে হবে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন বা তার আগে। প্রার্থীদের ঋণখেলাপি-সম্পর্কিত তথ্য নির্ভুলভাবে দেয়ার দায়িত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের। ভুল তথ্য দিলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত থেকে প্রার্থীদের খেলাপি ঋণের তথ্য মিলিয়ে দেখবেন এবং কোনো ঋণখেলাপি প্রার্থী হয়েছেন কি না, তা নিশ্চিত হবেন।
এর আগে গত ২৭ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের কাছে সম্ভাব্য সব প্রার্থীর তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলকারী প্রার্থীদের ঋণখেলাপ-সংক্রান্ত তথ্য দেয়ার লক্ষ্যে সব প্রার্থীর পূর্ণ নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, স্বামীর নাম (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বাংলা ও ইংরেজিতে পাঠানোর অনুরোধ করা হলো। একই সঙ্গে সব প্রার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর (এনআইডি), করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), জš§তারিখ এবং স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানার তথ্য পাঠাতে অনুরোধ করা হলো। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে একটি নির্দিষ্ট ছকও সংযোজন করে দেয়া হয়। তার আগে নির্বাচন কমিশন থেকে ঋণখেলাপিদের তথ্য দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীদের ঋণের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী প্রার্থীদের সিআইবি তথ্য যাচাই-বাছাই করে আমরা একটি প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছি। প্রতিবেদন তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সপ্তাহিক ছুটির দিনও অফিস করেছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে সারাদেশে প্রার্থীদের জমা দেয়া মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে এক হাজার ৯৮৫ প্রার্থী বৈধ ও ৭৩১ প্রার্থী অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
জানা যায়, ঢাকা মহানগরের ১৫টি সংসদীয় আসনে ১২৪ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা সাবিরুল ইসলাম। এসব আসনে ৬৪ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ ঋণখেলাপি ও ২৯ স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দেননি। আর ২০ প্রার্থী নির্ধারিত ছক পূরণ এবং যথাযথ কাগজপত্র দাখিল করেননি।