ইসমাইল আলী: সারাদেশে দূরপাল্লার রুটগুলোয় চলে বিভিন্ন মানের বাস। তবে এসব (নন-এসি) বাসের মূল্য ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। ব্যাংকঋণে কেনা এসব বাসের জন্য সুদ পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ২২ লাখ টাকা। সঙ্গে যুক্ত হবে নিবন্ধন ফি ৪২ হাজার টাকা। এতে প্রতিটি দূরপাল্লার বাসের পেছনে বিনিয়োগ ব্যয় পড়ছে প্রায় ৯৮ লাখ টাকা। এর ভিত্তিতে গত রোববার নির্ধারণ করা হয়েছে দূরপাল্লার বাস ভাড়া।
এখানেই শেষ নয় বাসের জ্বালানি ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ, দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও বিমা, চালক ও সহকারীর বেতন-ভাতা ইত্যাদি সবই যুক্ত হবে ভাড়ার মধ্যে। এভাবেই ১২টি খাতে ব্যয় যোগ করে দূরপাল্লার বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
সব ব্যয় যোগ করে প্রতি কিলোমিটারে দূরপাল্লার বাস ভাড়া দাঁড়িয়েছে এক টাকা ৮০ পয়সা। আগে এ হার ছিল এক টাকা ৪২ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া ৩২ পয়সা তথা ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যদিও বাস ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণে রয়েছে নানা ফাঁকি। ফলে ভাড়ার নামে মূলত বোঝা চেপেছে যাত্রীদের কাঁধে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ব্যয় বিশ্লেষণ হিসাব বলছে, প্রতিটি বাসের গড় আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০ বছর। প্রতি বছর বাসগুলো চলবে ৩০০ দিন। আর আসনের ৭০ শতাংশ যাত্রী বহন করবে বাসগুলো। যদিও বাস্তব চিত্র ঠিক উল্টো। আসনের প্রায় শতভাগ যাত্রী নিয়েই বেশিরভাগ সময় দূরপাল্লার বাস চলাচল করে। তবে ৭০ শতাংশ যাত্রী দেখানোয় কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বেশি পড়েছে।
দূরপাল্লার এসব বাস নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ইঞ্জিন ওভারহোলিং করতে হয়। তাই এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে বছরে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। আর বাস রং করাসহ রেনোভেশন ব্যয় বছরে তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি বাসে গড়ে ২২ দিনে টায়ার-টিউব পরিবর্তন করতে হয়। এতে বছরে টায়ার-টিউব লাগবে ১৪টি, যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৫৫ হাজার টাকা। আর বছরে দুটি ব্যাটারি লাগবে, যার মূল্য ৪০ হাজার টাকা।
দূরপাল্লার রুটে চলাচলকারী বাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর ব্যয়ও ভাড়ার মধ্যে যুক্ত হয়েছে, বছরে যা তিন লাখ টাকা। তার ওপর বাসের বিমা খরচ ধরা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। আর সিটি করপোরেশনের কোনো ধরনের টোল না থাকলেও এ খাতে বছরে ২৫ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
এদিকে বাস রাখার জন্য বছরে গ্যারেজ ভাড়া ধরা হয়েছে দুই লাখ টাকা। এছাড়া রোড ট্যাক্স ও ফিটনেস সংগ্রহে ব্যয় হবে বছরে ২৫ হাজার টাকা। আর চালক ও তার দুই সহকারীর দৈনিক মজুরি ধরা হয়েছে দুই হাজার ৫০০ টাকা। এতে বছরে এ খাতে ব্যয় হবে সাড়ে সাত লাখ টাকা।
তথ্যমতে, প্রতিটি বাস দৈনিক ৩৫০ কিলোমিটার চলাচল করে বলে ভাড়া নির্ধারণের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ দূরপাল্লার বাস প্রতিদিন গড়ে ৪৫০-৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলাচল করে। ফলে গড় চলাচল কম দেখিয়ে ভাড়ার হার বেশি ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতি লিটারে সোয়া তিন কিলোমিটার হিসাবে দৈনিক ডিজেল খরচ ধরা হয়েছে আট হাজার ৬১৫ টাকা। এতে বছরে খরচ হবে প্রায় ২৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
১২টি খাতে এ ব্যয়গুলো যোগ করে বছরে প্রতিটি দূরপাল্লার বাস পরিচালনায় ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৬৩ লাখ টাকা। এর সঙ্গে বাস মালিকের ১০ শতাংশ মুনাফা যোগ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রতি কিলোমিটার বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক টাকা ৮০ পয়সা।
যদিও ব্যয় বিশ্লেষণের নামে মূলত যাত্রীদের কাঁধে ভাড়ার বোঝা চাপানো হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, বিভিন্ন জেলায় চলাচলকারী বাস সব একই মানের নয়। এমনকি একই রুটে একাধিক কোম্পানির বাস রয়েছে, যার মান ভিন্ন ভিন্ন। আর দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটে চলা এসব বাসের দাম ৩৫-৪০ লাখ টাকার বেশি নয়।
তিনি আরও বলেন, ব্যয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বাসের বাজার মূল্য কত, বাসটি দৈনিক কত পথ পাড়ি দেয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কত বা বছরে কতগুলো যন্ত্রাংশ ও টায়ার-টিউব পরিবর্তন করতে হয়Ñএসব কখনোই সরেজমিন যাচাই করেনি বিআরটিএ। মালিকদের কথামতো ব্যয় বিশ্লেষণ হিসাবের সময় একটি অঙ্ক বসিয়ে দেয়া হয়। ফলে বাস ভাড়া কখনোই বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন করে না।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি বলেন, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাস ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণের কাঁধে বোঝা চাপানোর কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, দূরপাল্লার বাস ভাড়া ৫২ আসনের ক্ষেত্রে হিসাব করা হয়। তবে যাত্রীদের সুবিধার্থে আসন সংখ্যা কমানো ও দুই সারির আসনের মাঝে দূরত্ব বাড়ানোর বিধান রেখেছে বিআরটিএ। এতে আসন অনুপাতে ভাড়া সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। ফলে দূরপাল্লার বেশিরভাগ বাসই ৩৬-৪০ আসনের হয়।
এতে ৫২ আসনের বাসের জন্য দূরপাল্লার রুটে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সা হলেও ৪০ আসনের বাসের ক্ষেত্রে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই টাকা ৩৪ পয়সা। আর ৩৬ আসনের বাসের ক্ষেত্রে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় দুই টাকা ৬০ পয়সা। এছাড়া দূরপাল্লার যেসব রুটে ফেরি বা সেতু রয়েছে, সেসব রুটের ভাড়ার সঙ্গে ফেরির চার্জ বা সেতুর টোলও আসন অনুপাতে যুক্ত করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।