নিজস্ব প্রতিবেদক : কভিড মহামারি-পরবর্তী সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, যে সমস্যা থেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন তাদের অনেকে। এমন দাবি করল আঁচল ফাউন্ডেশন। এক সীমাক্ষা চালিয়ে এমন ফল পাওয়া গেছে বলে সংগঠনটি জানিয়েছে। দেশের বিভিন্ন পাবলিক, বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসায় লেখাপড়া করা এক হাজার ৬৪০ শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে তারা দেখতে পেয়েছে, ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা-সংক্রান্ত সমস্যা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিলেন।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া কভিড মহামারির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশাকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক চাপেও পড়াশোনায় অনীহা তৈরি, অভিভাবকদের চাপ ও কভিডের ফলে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার ‘করোনা-পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একাডেমিক চাপের প্রভাব এবং তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শিরোনামে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই সমীক্ষার প্রতিবেদন তুলে ধরে আঁচল। সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আব্দুল ওহাব।
জরিপে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার মোট এক হাজার ৬৪০ শিক্ষার্থী অংশ নেন। শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা মাথায় এসেছে ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর। আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে এসেছেন ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
বেড়েছে ভয় ও আশঙ্কা: জরিপে মানসিক সুস্থতা-বিষয়ক বেশ কয়েকটি নিয়ামক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে উত্তরে আসে ‘উদ্বেগজনক’ কিছু তথ্য। মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কভিড মহামারি-পরবর্তী সময়ে তাদের নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগে তারা জর্জরিত।
পাশাপাশি দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহারে পরিবর্তনও এসেছে শিক্ষার্থীদের জীবনে। যেমন, মন খারাপ হওয়া, হঠাৎ ক্লান্তিসহ নানা বিষয় তাদের শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছে বলে জানান ৮০ দশমিক ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ডিজিটাল আসক্তিতে মানসিক সমস্যা: দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ হয়ে যাওয়া ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মধ্যে মোবাইল, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের ওপরে অতিরিক্ত আসক্তি ও নির্ভরতা শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন ৭০ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
আবার মানসিক সমস্যাজনিত কারণে নিত্যদিনের ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। যেমন অতিরিক্ত ঘুম অথবা নিদ্রাহীনতায় ৭১ দশমিক ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী ভুগছেন, যা লেখাপড়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
নিজেকে গুটিয়ে নেয়া: ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের কথাও জানান জরিপে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা। যেমন হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া বা অনেক কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, বহির্মুখী (এক্সট্রোভার্ট) কিংবা আত্মকেন্দ্রিক (ইন্ট্রোভার্ট) হয়ে ওঠার প্রবণতাও তার শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করছে বলে জানান ৪৭ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অভিভাবকদের ‘অযাচিত’ চাপ। অভিভাবকদের অতিরিক্ত স্বপ্ন বা প্রত্যাশার চাপে ৫৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী হাঁসফাঁস করছেন বলে জানায় আঁচল। অনেক শিক্ষার্থীই মনে করছেন, পরিবার থেকে তৈরি হওয়া ‘অযাচিত’ চাপে তারা পিষ্ট।
একাডেমিক চাপে নাজেহাল হওয়া: কভিড মহামারি-পরবর্তী বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে পড়েছেন। এটি ৭৭ দশমিক ০১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে বলে উঠে এসেছে এবারের সমীক্ষায়।
একইসঙ্গে একাডেমিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যবর্তী সময় কম থাকায় ৬৭ দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ বিরতির পর লেখাপড়ার ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আসায় ৭৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর মাঝে আত্মবিশ্বাস আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে। এছাড়া সিলেবাস দ্রুত শেষ করার চাপে ৬৬ দশমিক ৭১ শিক্ষার্থীর বিভিন্ন ধরনের মনের সমস্যা তৈরি হয়েছে।
ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা: ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, চাকরি ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার কারণে মানসিক চাপে আছেন। এর মধ্যে ৭২২ মেয়ে ও ৫৩৫ ছেলে রয়েছে। এতে দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে মেয়েরা ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি চিন্তিত।
সেশনজটের শিকার ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী: আঁচল ফাউন্ডেশনের এবারের জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেয়াদে সেশনজটের শিকার হয়ে আটকে পড়েছেন। এদের মাঝে ৪২ দশমিক ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তারা ন্যূনতম এক বছর সেশনজটের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ন্যূনতম এক বছর শিক্ষাজীবনে পিছিয়ে পড়েছেন।
আবার দুই বছর সেশনজটের শিকার হয়েছেন ১৩ দশমিক ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ছয় মাস ও অন্যান্য মেয়াদে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী এর ভুক্তভোগী। সেশনজটের শিকার হওয়ায় পারিবারিক ও সামাজিক চাপ বেড়েছে বলে জানান ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ক্যারিয়ার ভাবনায়ও বিপদ সংকেত: শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক ভাবনায় সবচেয়ে এগিয়ে রাখছে সরকারি চাকরিকে। ৩৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হতে চান?। আবার ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান। বেসরকারি চাকরি করতে আগ্রহী মাত্র ৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে ব্যবসা ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান গড়তে চান ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর সরকারি চাকরি পাওয়ার ঝোঁক কিছুটা ভীতিজাগানিয়া। কারণ তাদের মাঝে যারা সরকারি চাকরি পেতে ব্যর্থ হবেন, তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন।
বিশেষজ্ঞ মতামত: বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ এবং বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি ড. মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, করোনার সময়ে ও করোনা-পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেক গবেষণায় ও খবরে উঠে এসেছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মানসিক শান্তির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা এবং আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। যে সমস্যাগুলো নিয়ে তারা ভুগে থাকেন, তাদের অনেকগুলোরই চাইলে সমাধান করা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি, মন খুলে কথা বলার মতো সামাজিক পরিবেশ তৈরি প্রভৃতির মাধ্যমেও তাদের এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।’
সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা: শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য দায়ী সমস্যাগুলো বিবেচনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে।