৭ ব্যাংকে বেক্সিমকোর নামে-বেনামে ঋণ ৩৬ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব: সরকারি-বেসরকারি সাতটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ। এসব ঋণের অধিকাংশই নেয়া পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া। আবার বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করেও পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধা নিয়ে থেকেছে খেলাপি মুক্ত।
রাজনৈতিক বিবেচনায় বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন সুবিধা দেয়া হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ঋণ বের করে নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম সালমান এফ রহমান। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেই ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়া হয়। এই টাকা বের করতে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। এছাড়া রাখা হয়নি পর্যাপ্ত জামানতও। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব জেনেও চুপ ছিল। তাই এসব ঋণ এখন ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ ঋণই খেলাপির ঝুঁকি রয়েছে।

জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেক্সিমকো গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে। এ ব্যাংকে বেশিরভাগ ঋণই ছিল তার বেনামি। এতদিন তার নামে জনতা ব্যাংক ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা দেখিয়ে আসছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তার ২৯ প্রতিষ্ঠানে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ২১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঋণের তথ্য বেরিয়ে আসে।

গত ২০২৩ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে সালমান এফ রহমানের দুই প্রতিষ্ঠানে ২৩ হাজার ৭০ কোটি টাকার ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ২০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, যার ফান্ডেড ২০ হাজার ২০৮ কোটি এবং নন-ফান্ডেড ৫৪৪ কোটি টাকা। আর বেক্সিমকো লিমিটেডের ফান্ডেড এক হাজার ৯৯৪ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৩২৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একক গ্রাহককে মূলধনের ২৫ শতাংশের (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) বেশি ঋণ দেয়ার নিয়ম নেই। তবে জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকেই ব্যাংকের মূলধনের ৯৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ সুবিধা দিয়েছে।


আইএফআইসি থেকেও নামে-বেনামে ঋণ সালমান এফ রহমান নিজের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের নামে-বেনাম ঋণ বের করেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রীপুর টাউনশিপ প্রতিষ্ঠানের নামে নন-ফান্ডেড এক হাজার ২০ কোটি টাকা, সানস্টার বিজনেসের নামে ৬১৫ কোটি, ফারইস্ট বিজনেসের নামে ৬১৪ কোটি টাকা, কসমস কমোডিটিস লিমিটেডের নামে ৬১২ কোটি, অ্যাপোলো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ৪৫৫ কোটি, আল্ট্রন ট্রেডিং লিমিটেডের নামে ৪৪৯ কোটি, নর্থস্টোন কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ৪২১ কোটি, আলফা এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ৫৬৯ কোটি এবং অ্যাবসলিউট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের নামে ৪৬৩ কোটি টাকার ঋণ নেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বেনামি।

বাদ যায়নি ধুঁকতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক: বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে টাকা বের করে নিয়েছেন। ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে এসব ঋণ বহু বছর আগের। তবে কোনো অর্থ পরিশোধ না করেই নিয়মিত থেকে যাচ্ছেন।

জানা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ফান্ডেড ৮৩৬ কোটি টাকা, বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে ফান্ডেড ৮২৩ কোটি টাকা, বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট ১ ও ২ অনুকূলে ফান্ডেড এক হাজার ২৩৪ ও নন-ফান্ডেড ৫৯ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন।

সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে দীর্ঘদিনের ঋণ: জনতা ব্যাংকের থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত অপর তিন ব্যাংকও বাদ যায়নি। তথ্য অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো লিমিটেডের ফান্ডেড ৬৬৩ কোটি টাকা, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড নিয়েছে ফান্ডেড ৩৭৫ কোটি টাকা এবং বেক্সিমকো কমিউনিকেশন লিমিটেড ফান্ডেড ৩০০ কোটি ও নন-ফান্ডেড ৭১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। রূপালী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো লিমিটেডে ৯৬৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এছাড়া সোনালী ব্যাংকে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুনর্গঠিত ঋণ এক হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এসব ঋণ পরিশোধ না করার পরও নিয়মিত রয়েছে। অথচ পুনর্গঠিত ঋণের দুই কিস্তি পরিশোধ না করলেই ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার কথা।

এবি ব্যাংকে সালমান এফ রহমানের চার প্রতিষ্ঠান ঋণ রয়েছে। সবগুলো ঋণই পুনর্গঠিত। এ ব্যাংকের ঋণও বছরের পর বছর পরিশোধ করা হয়নি। ঋণগুলো ২০১৫ সালে পুনর্গঠিত করা হয়। বর্তমানে চার প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডের ১২০ কোটি। একই প্রতিষ্ঠানে আরও ৫৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলসের ৮৩ কোটি এবং নিউ ঢাক্কা ইন্ডাস্ট্রিজের ৩৪৫ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানান, যে কোনো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জামানতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ক্যাশ ফ্লো বিবেচনায় নেয়া হয়। মূলত ঋণটা কীভাবে ফেরত আসবে বা ঋণ শোধের ম্যাকানিজম হিসেবে ক্যাশ ফ্লো আছে কিনা, সেটি দেখা হয়। এরপর ওই ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সহায়ক জামানত নেয়া হয়। তবে সহায়ক জামানতের বিষয়টি যাদের চিনি না, তাদের ক্ষেত্রে বেশি হারে প্রযোজ্য হয়। আবার বড়দের সবাই ঋণ দিতে এতটাই আগ্রহী থাকে যে, সহায়ক জামানত চাওয়ার সুযোগও থাকে না। এক্ষেত্রে এসব ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়েও শঙ্কা বেশি থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালাক (এমডি) বলেন, সালমান এফ রহমান রাজনৈতিকভাবে এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে কিস্তি পরিশোধ না করলেও তাদের কিছু বলা যেত না। বাংলাদেশ ব্যাংকও জেনে চুপচাপ ছিল। তাই এসব ঋণ দীর্ঘদিন আদায় ছাড়াই পড়ে আছে। এসব ঋণের অধিকাংশই খেলাপি যোগ্য। যেহেতু ঋণগুলো পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই দেয়া হয়েছে, তাই এই টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

তারা আরও বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে এখন যদি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। তাহলে কিছু টাকা হলেও উদ্ধার করা যাবে। তাই সরকারের উচিত হবে এসব ঋণের ব্যাপারে নজর দেয়া।উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল। তার নামে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০