Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 6:18 pm

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে সম্প্রচারের আহ্বান

কাজী সালমা সুলতানা: ৫ মার্চ ১৯৭১। বিক্ষোভ আর প্রতিরোধে উত্তাল হওয়াসহ এদিনও হরতাল পালিত হয়। গোটা পূর্ব পাকিস্তানে চলতে থাকে মিছিল, মিটিং ও বিক্ষোভ। একেকটি দিন যাচ্ছে আর আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়ছে। বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক ও স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের পর রাওয়ালপিন্ডি শাসকগোষ্ঠী নড়েচড়ে বসে।

এদিন মুক্তিকামী বাঙালি সেøাগানে সেøাগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ প্রভৃতি সেøাগানে মুখর রাজপথ।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন আর হরতালের সময় সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে ৫ মার্চ চট্টগ্রামে ২২২ জন ও টঙ্গী শিল্প এলাকায় চার শ্রমিক শহিদ হন এবং ২৫ শ্রমিক আহত হন। এ সংবাদে ঢাকায় জনসাধারণের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

এদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ৩২৫ কয়েদি মিছিল করে শহিদ মিনারে চলে আসেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। কারাগারের ফটক ভাঙার সময় প্রহরীর গুলিতে সাত কয়েদি প্রাণ হারান। সন্ধ্যায় সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, ঢাকায় আজ সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।

এদিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণাকে অবাঞ্ছিত ও অগণতান্ত্রিক হিসেবে ঘোষণা করে বেলুচিস্তান ন্যাপ। এছাড়া ‘সংখ্যাগুরু দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশের সংহতি রক্ষা করা অপরিহার্য’ বলে এয়ার ভাইস  মার্শাল (অব.) আসগর খান মন্তব্য করেন। মাওলানা গোলাম গাউস হাজারী জানিয়ে দেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সব নির্বাচিত সদস্যের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার ভুট্টোর নেই। মানিক গোলাম জিলানী বলেন, অবিলম্বে সংখ্যাগুরু দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এসব নেতার কোনো বক্তব্যকেই গুরুত্ব দেয়নি।

এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ব্যাংক খোলা থাকে। গত কয়েক দিনে গুলিতে যারা মারা গেছেন, সেসব শহিদের আত্মার শান্তি কামনায় মসজিদে বিশেষ মোনাজাত আয়োজিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। লাহোরেও দেশের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে গায়বানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সংকটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। ২০ হাজার বাঙালির লাশ হলেই আন্দোলন থেমে যাবেÑভুট্টোর এমন অভিলাষ বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুতি নিতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকালে করাচি থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ-ভাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসদুদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকালে কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষকরা মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের হয়। ১১ দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমেদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতারকেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান। রাতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারিরা গুলি করে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করছে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর বৈঠক শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, তা অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।