সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এক দশক আগে পতেঙ্গার রাসমণি ঘাট এলাকার সমুদ্র উপক‚লে বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের ভূমির প্রয়োজন ৮৭০ একর। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ৪০০ কোটি টাকাও বেশি টাকা ব্যয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬৭ একর জমির দখল বুঝে নেয়। বাকি সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা খাস জমি ৮০৩ একর। এ জমি কেনার আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বন্দর নামমাত্র মূল্যে বা প্রতীকী মূল্যে নেয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। নানা জটিলতায় এ খাস জমি বরাদ্দ পেতে বেগ পোহাতে হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, দেশের আমদানি ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ বে টার্মিনাল প্রকল্প। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প হলো বে টার্মিনাল। নগরীর পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকার সাগরতীর ঘেঁষে প্রস্তাবিত এ টার্মিনালের জেটিতে ১২ মিটার গভীরতার এবং ২৮০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভিড়তে পারবে। কর্ণফুলীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান জেটিগুলোয় ৯ দশমিক ৫ মিটার গভীরতা ও ১৯০ মিটারের বড় কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না। আর বে টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা হবে প্রায় ৫০ লাখ টিইইউএস। অর্থাৎ এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ পণ্য হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। গত বছর দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দর ৩২ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্ত জমি অধিগ্রহণ জটিলতা, চ‚ড়ান্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, অর্থায়নসহ নানা জটিলতায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি।
বন্দর কর্তৃপক্ষের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত ৮৭০ একর ভ‚মির মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৬৭ একর জমি বন্দর কর্তৃপক্ষ কিনে নিয়েছে। এ জমিতে ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণসহ বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ চলছে। বাকি ৮০৩ একর সরকারি খাস জমি অধিগ্রহণের জন্য চেষ্টা চলছে। তবে এ জমি বুঝে পেতে বিলম্ব হচ্ছে। সরকারি খাস জমি নামমাত্র মূল্যে পাওয়া গেলে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হবে। বে টার্মিনালের প্রতিটি টার্মিনালে ৩০০ মিটার করে ছয়টি জেটি থাকবে। কমপক্ষে পাঁচ হাজার টিইইউএস ধারণক্ষমতার প্রায় ১২ মিটার ড্রাফট ও ২৮৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ নোঙর করতে পারবে। একসঙ্গে ৩৫টি জাহাজ এই টার্মিনালে নোঙর করতে পারবে এবং অতিরিক্ত ৫০ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে।
তারা আরও বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে বে টার্মিনাল চালু করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। এর মধ্যে প্রকল্পের জন্য একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কনসালটেন্ট মনোনীত করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের ডিজাইন ও টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করবে প্রতিষ্ঠানটি। ভ‚মি মিললে এবং কনসালটেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদিত হলে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যাবে।
বে টার্মিনালের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করার তাগিদ দিয়ে আসছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বে টার্মিনাল নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এ প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি দেখছি না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিয়াল এম শাহজাহান বলেন, বে টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ থেমে নেই। হয়তো পরিকল্পনা পর্যায়ে আছে বলে কাজ দেখা যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৮০৩ একর খাস জমি প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ পাওয়ার জন্য ভ‚মি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। কারণ ৮০৩ একর জমি কেনার মতো ফান্ড চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব তহবিলে নেই।
এছাড়া আমরা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে টেন্ডার আহŸান করছি। তিনি আরও বলেন, বে টার্মিনালে তিনটি টার্মিনাল হবে। এর মধ্যে একটি বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে হবে। বাকি দুটি টার্মিনাল হবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে। এ দুটি টার্মিনাল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। এর জন্য বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাব যাচাই-বাছাইও হচ্ছে। দেশের জন্য সার্বিকভাবে যা ভালো তা বিবেচনায় নেয়া হবে। কিছুদিন আগেও আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল নির্মাণে এরই মধ্যে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, সিঙ্গাপুরের পিএসএ, ভারতের আদানি গ্রুপ, সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজেটি) এবং দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ওশান অ্যান্ড ফিশারিজ মিনিস্ট্রি বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল।