৮২৮ কোটির লোকসান বেড়ে ৫১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা

গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের বিক্রয় মূল্য। এরপরও বিদ্যুৎ খাত বিশেষত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বেড়ে চলেছে। ফলে বেড়েছে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি। এরপরও বিদ্যুৎ খাতে ব্যয়ের চিত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস নামে গত অর্থবছর। গত জুলাই থেকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং। ফলে সারাবছর বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলেছে সক্ষমতার অর্ধেকেরও কম। তবে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই গুনতে হয়েছে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের। এছাড়া ডিসেম্বর পর্যন্ত জ্বালানি তেল ও কয়লার উচ্চ দাম এবং ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ অনেক বেড়েছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। সূত্রমতে, ডলারের বিনিময় হারে ১ টাকা অবমূল্যায়নে পিডিবির লোকসান বাড়ে ২৩০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সংস্থাটির লোকসান রেকর্ড বেড়েছে ১৮ হাজার ৬৩৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা বা ৫৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

পিডিবির ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন (সাময়িক হিসাব) বিশ্লেষণে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৫২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এ ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছে ভর্তুকি চায় সংস্থাটি। এতে গত অর্থবছরের জন্য ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। যদিও গত জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র সাত হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। বাকিটা ধীরে ধীরে ছাড় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ভর্তুকি বাদ দিয়েও বিদায়ী অর্থবছর ১১ হাজার ৯৯০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ঘাটতি রয়ে গেছে পিডিবির।

যদিও ডলারের অবমূল্যায়নের কারণে গত অর্থবছরের নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের বড় লোকসানের আভাস দিয়েছিল পিডিবি। ওই সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এক বৈঠকে জানানো হয়, ডলারের এক টাকা বিনিময় হার বৃদ্ধিতে পিডিবির লোকসান বাড়ে বছরে ২৩০ কোটি টাকা। সে সময় আরও জানানো হয়, ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা থাকলে ২০২২-২৩ অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াত ৩৯ হাজার কোটি টাকা। তবে ডলারের দর ১০৭ টাকা হলে এ লোকসান বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ শুধু ডলারের অবমূল্যায়নের জন্য লোকসান বেড়ে যাবে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ডলারে। যদিও বর্তমানে কুইক রেন্টালের সংখ্যা কমে এসেছে, তার পরও বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোকে ডলারেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পর বেসরকারি খাতে বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়।

ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ সরাসরি ডলারে পরিশোধ করা হয় না। তবে আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিনিময় হার নির্ধারিত হয় সোনালী ব্যাংকের বিনিময় হারে। ফলে সরাসরি ডলার না লাগলেও কয়েক মাসে টাকার অবমূল্যায়নে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান ওই সময় শেয়ার বিজকে বলেছিলেন, ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে লোকসান বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তবে এটা সরকারের নীতিগত বিষয়। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই।

এদিকে পিডিবির গত ১৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত পিডিবি লোকসান গুনেছে এক লাখ ৬১ হাজার ১৮৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তবে মাত্র শেষ দুই অর্থবছর ৮৪ হাজার ৪১২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে পিডিবি। অর্থাৎ ১৫ বছরে পিডিবির লোকসানের ৫২ দশমিক ৩৭ শতাংশই হয়েছে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে। আর ২০০৮-০৯ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে গত অর্থবছর লোকসান ৬২ গুণ বা ছয় হাজার ২১৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।

সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছিল ৩২ হাজার ৮৮৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়েছে ২১ হাজার ২৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বা ১৮২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়েছিল ৫৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা চার হাজার ২০০ কোটি টাকা।

২০০৮-০৯ অর্থবছর পিডিবি লোকসান গুনেছিল মাত্র ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। পরের (২০০৯-১০) অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। তবে ২০১০-১১ অর্থবছর লোকসান এক লাফে সাতগুণের বেশি বেড়ে হয় চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর তা আরও বেড়ে ৪৪ শতাংশ বেড়ে হয় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

পরের দুই অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছর লোকসান ৩৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রায় সাত শতাংশ বেড়ে হয় সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রায় ৪৭ শতাংশ কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পিডিবির লোকসান আবারও বাড়ে। ওই অর্থবছর লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

২০১৭-১৮ অর্থবছর পিডিবির লোকসান অনেকখানি বাড়ে। ওই অর্থবছর ১১০ শতাংশ বাড়ে সংস্থাটি। এতে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তবে পরের দুই অর্থবছর তা আবার কমে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর লোকসান হয় আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর আরও কিছুটা কমে হয় সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে পিডিবির লোকসান লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০