৯ খাতে এমআরপি বসলে রাজস্ব বাড়বে কয়েক হাজার কোটি টাকা

রহমত রহমান: উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে (এমআরপি) পণ্য বাজারজাত করছে। ভোক্তাও এমআরপি মূল্যে সেই পণ্য কিনছেন। আর এমআরপি মূল্যের মধ্যে কোম্পানির খরচ, লাভ, ভ্যাট (মূসক), ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরের লাভসহ সবই থাকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই যে, উৎপাদন পর্যায় ছাড়া আর কোন পর্যায়ে যেমন ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর ও ভোক্তা পর্যায়ে কোনো ভ্যাট আদায় হচ্ছে না। আবার এমআরপি লেখা হলেও অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়েও অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ভ্যাট আদায় হচ্ছে না। সে জন্য সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় করা হলে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বেশি নয়, বড় মাত্র নয়টি খাতে এমআরপির ওপর ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর আদর্শ হারে ভ্যাট আদায়ে বর্তমান মূসক আইন, বিধি ও তফসিলে কোনো বিধান নেই। সে জন্য সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় হলে সকল পর্যায়ের ভ্যাট আদায় নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন তারা। আগামী বাজেটে বিষয়টি বিবেচনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, দেশে নয়টি খাতে বাজার বাড়ার সঙ্গে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ বাড়ছে। খাতগুলো হলোÑসিগারেট, বেভারেজ, সোপ, টয়লেট্রিজ, কসমেটিকস, টাইলস, সিমেন্ট, পেইন্টস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইলেকট্রনিক। নয় খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সিগারেট খাতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, বেভারেজ ১০ হাজার কোটি, টয়লেট্রিজ ও কসমেটিকস খাতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি, সিরামিক টাইলস ৮ হাজার কোটি, রংশিল্পে ৩ হাজার কোটি, সিমেন্ট খাতে ২৫ হাজার কোটি ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইলেকট্রনিক খাতে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। নয়টি খাত থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থবছর প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, নয়টি খাতের মধ্যে সিগারেট খাত থেকে সর্বোচ্চ ভ্যাট আদায় হয়। সিগারেটে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বা এমআরপি বিষয়ে বাজেটে নির্দেশনা দেয়া হয়। সে অনুযায়ী এসআরও জারি করে এনবিআর। কিন্তু এসআরও’র গ্যাঁড়াকলে পড়ে সিগারেট খাতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সিগারেটের প্যাকেটে খুচরা মূল্যের আগে ‘সর্বোচ্চ’ শব্দ লেখা নেই। আর তাতেই প্রতিদিন সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ২০ কোটি ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত চলে যাচ্ছে, যা মাসে প্রায় ৬০০ কোটি আর বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সিগারেট কিনতে ভোক্তার পকেট থেকে যাওয়া এ টাকার ওপর প্রতিদিন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ১৩ কোটি ৬৮ লাখ, মাসে প্রায় ৪১০ কোটি ৪০ লাখ এবং বছরে প্রায় ৪ হাজার ৯৯৩ কোটি ২০ লাখ কোটি টাকা। সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্যের চেয়ে খোলাবাজারে অধিক মূল্যে সিগারেট বিক্রয় হওয়ায় সরকার এ রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, মূসক আইন ও বিধিতে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ লেখা থাকলেও সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রভাব খাটিয়ে এসআরও-তে ‘বিক্রয়মূল্য বা খুচরা মূল্য’ লেখিয়ে নিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ শব্দ লিখছে না। এতে একদিকে ভোক্তা ঠকছে, অন্যদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ খাতে রাজস্ব ফাঁকি রোধে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এসআরও সংশোধন করতে প্রস্তাব দিয়েছে বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)।

অন্যদিকে, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের (এমআরপি) ওপর আদর্শ হারে ভ্যাট গ্রহণ বিষয়ে বর্তমান মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২, বিধি এবং তফসিলে কোনো বিধান নেই। সে জন্য আগামী এমআরপিতে যেসব পণ্য বাজারজাত করা হয়, সে সকল পণ্যে এমআরপি মূল্যের ওপর আরোপিত মূসক পেট্রোলিয়াম পণ্যের ন্যায় উৎপাদন পর্যায়ে আদায়ের বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে এলটিইউ। প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এমআরপি মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে এবং এমআরপি মূল্যের ওপর ক্রেতা সাধারণ মূসক পরিশোধ করছে। যেসব পণ্য যেমনÑ বেভারেজ, সোপ, টয়লেট্রিজ, কসমেটিকস, টাইলস, পেইন্টস, সিমেন্ট, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইলেকট্রনিকস প্রভৃতি এমআরপির ভিত্তিতে বিক্রয় হয়, সে সকল পণ্যের এমআরপি মূল্যের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানের মূসক আরোপযোগ্য মূল্য ও ডিলার ডিস্ট্রিবিউটরসহ পরবর্তী সব পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর অন্তর্ভুক্ত থাকে বিধায় পেট্রোলিয়াম পণ্যের ন্যায় পণ্যের এমআরপি মূল্যের প্রযোজ্য মূসক উৎপাদন পর্যায়ে আদায় করা যেতে পারে। আরও বলা হয়, বর্তমানে উৎপাদন পর্যায় ব্যতীত অন্যান্য পর্যায়ে যেমনÑডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর ও ভোক্তা পুরোপুরি ভ্যাট আদায় হয় না। কাজেই সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় হলে সকল পর্যায়ের ভ্যাট আদায় নিশ্চিত হবে।

অন্যদিকে, এমআরপি মূল্যের ওপর আদর্শ হারে ভ্যাট গ্রহণ এবং প্রযোজ্য নতুন উপকরণ-উৎপাদ সহগ ঘোষণা ফরম প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে এলটিইউ। বর্তমানে এ বিষয়ে আইন ও বিধিতে কোনো বিধান নেই। বেভারেজ, সোপ, টয়লেট্রিজ, কসমেটিকস, টাইলস, পেইন্টস, সিমেন্ট, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইলেকট্রনিকস প্রভৃতি যেসব পণ্য এমআরপি-এ বাজারজাত করা হয়। সেসব পণ্যে এমআরপির ওপর প্রযোজ্য মূসক উৎপাদন পর্যায়ে আদায়ের বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা যায় এবং নতুন উপকরণ-উৎপাদ সহগ প্রণয়ন করা যায় বলে প্রস্তাবে বলা হয়েছে। যুক্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমান মূসক আইনে এমআরপি মূল্যে পণ্য বাজারজাতকরণে কোনো আইনগত বিধান নেই। তবে বাস্তবে এমআরপি মূল্যের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাজারজাত করা হচ্ছে এবং এ এমআরপি মূল্যের ওপর ক্রেতারা মূসক পরিশোধ করছেন। যেসব পণ্যে যেমনÑবেভারেজ, সোপ, টয়লেট্রিজ, কসমেটিকস, টাইলস, পেইন্টস, সিমেন্ট, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইলেকট্রনিকস প্রভৃতি এমআরপির ভিত্তিতে বিক্রি হয়। এ এমআরপি মূল্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের মূসক আরোপযোগ্য মূল্য ও ডিলার ডিস্ট্রিবিউটরসহ পরবর্তী সকল পর্যায়ের মূল্য সংযোজন অন্তর্ভুক্ত থাকে বিধায় সঠিক ভ্যাট আদায়ের জন্য পেট্রোলিয়ামের ন্যায় উৎপাদন পর্যায়ে এমআরপি মূল্যের ওপর ভ্যাট আদায় করা যায়। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনগত বিধান অনুযায়ী উৎপাদন পর্যায়সহ পরবর্তী মূল্য সংযোজনের খাতসমূহের উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করতে পারে। এ ধরনের মূসক আদায়ের ক্ষেত্রে এমআরপি মূল্যের পণ্যে উপকরণ উৎপাদ ঘোষণা সহগ নতুন মূসক ফরম প্রণয়ন করা প্রয়োজন হবে।

এনবিআরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রধান নয়টি খাতের রাজস্ব বিশেষণে দেখা গেছে, সিগারেট খাত থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৬১৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা ওই অর্থবছর পণ্য খাতে মোট আহরণের শতকরা ৪৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছর সিগারেট থেকে আদায় হয়েছে ২৫ হাজার ৩৬২ কোটি ২২ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাতে মোট আহরণের ৪৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে, সিগারেট খাতে ২০২০-২১ অর্থবছর আদায় হয়েছে ২৬ হাজার ৯২০ কোটি টাকার বেশি। সিমেন্ট খাত থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৬২৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৩০০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ।

আরও দেখা গেছে, বেভারেজ খাত থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৯৮০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৭৪২ কোটি ৬০ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সিরামিক ও টাইলস খাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৬৯৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৬০২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের ১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সাবান ও ডিটারজেন্ট খাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৫৪১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৪৯০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা; যা ওই অর্থবছর পণ্য খাত থেকে আহরণের শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছর আদায় হয়েছে ৬৬০ কোটি ১১ লাখ টাকা।

হিসাব অনুযায়ী, দেশে বেভারেজ খাতের বাজার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এইচডিআরসি’র ২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে সিগারেটের বাজার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য গত সাত বছরে (২০১৫-২০২২) এই বাজার আরও বড় হয়েছে। বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ আমদানিকারক সমিতির তথ্যমতে, দেশে প্রসাধনীর বাজার প্রায় চার কোটি টাকার। বিসিএমইএর তথ্যমতে, দেশের অভ্যন্তরে সিরামিক পণ্যের বাজার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। দেশে ২০১৬ সালে রংশিল্পের বাজার ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি। এই ছয় বছরে (২০১৬-২০২২) আরও হাজার কোটি বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী ৪০টি কোম্পানির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দেশে সিমেন্টের বাজার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশে ব্যবসায়িক তথ্যের উৎস ডাটাবিডি.কো অনুসারে, ২০২০ সালে দেশের স্থানীয় ভোক্তা ইলেকট্রনিকস বাজার ছিল ৩১৪ কোটি মার্কিন ডলার। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ৫১৭ কোটি ডলার হবে (প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা)। আর ২০২০-২১ অর্থবছর হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০