৯ বছরে বিপিসির নিট মুনাফা ৪৪ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক বাজারে লম্বা সময় ধরে নিম্নমুখী থাকলেও দেশে ছয় বছর কমানো হয়নি জ্বালানি তেলের দাম। এতে সাত বছরে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে সংস্থাটি। তবে ২০২১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। ২০২২ সালের জুনে তা রেকর্ড পৌঁছায়। এতে ২০২১-২২ অর্থবছর লোকসানের মুখে পড়ে দেশে জ্বালানি তেলের একমাত্র আমদানিকারক ও বিপণনকারী সংস্থাটি।

যদিও জুলাই থেকে আবারও আন্তর্জাতিক কমতে শুরু করে তেলের দাম। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ দামের যুক্তিতে গত বছর আগস্টে দেশে রেকর্ড বাড়ানো হয়েছিল সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। এতে গত অর্থবছর আবারও বড় মুনাফা করেছে বিপিসি। সব মিলিয়ে ৯ বছরের মধ্যে ৮ বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৭ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। শুধু ২০২১-২২ অর্থবছর সংস্থাটি লোকসান গুনেছিল ২ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা। এতে ৯ বছরে বিপিসির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। সংস্থাটির গত ৯ অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

গত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর বিপিসি আয় করেছে ৭৯ হাজার ১৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছর সংস্থাটির আয় ছিল ৫৩ হাজার ৫৭৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর সংস্থাটির আয় বেড়েছে ২৫ হাজার ৬১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বা ৪৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর গত অর্থবছর বিপিসির কস্ট অব গুডস সোল্ড ছিল ৭৩ হাজার ১৪৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, এর আগের অর্থবছর যা ছিল ৫৭ হাজার ১২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর সংস্থাটির কস্ট অব গুডস সোল্ড বেড়েছে ১৬ হাজার ১৩২ কোটি এক লাখ টাকা বা ২৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।

জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় কমায় গত অর্থবছর কস্ট অব গুডস সোল্ডের তুলনায় আয় অনেক বেশি বেড়েছে। এর প্রভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছর বড় মুনাফা করেছে বিপিসি। অন্যান্য আয়-ব্যয় সমন্বয় করে গত অর্থবছর সংস্থাটি মুনাফা করেছে চার হাজার ৫৮৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৫৪ দশমিক ৭৭ ডলার। এরপর প্রতি মাসেই তা বেড়েছে। ওই বছর জুনে তা পৌঁছায় ৭৫ দশমিক ১৭ ডলারে। পরের মাসগুলোয় দ্রুত বাড়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। যদিও মাঝে ২-৩ মাস কিছুটা হ্রাস পায়। এতে ২০২২ সালের জুনে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম পৌঁছায় ১২২ দশমিক ৭১ ডলারে।

পরের মাস থেকেই তা টানা কমতে শুরু করে। মাঝে দু’এক মাস সামান্য বাড়লেও ২০২৩ সালের জুনে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল পৌঁছায় ৭৪ দশমিক ৮৪ ডলারে, যা ২০২১ সালের জুনের চেয়েও কম। এর মধ্যে লোকসানের যুক্তিতে দেশের বাজারে আগস্টে তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। যদিও সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী ছিল। ওই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ১০০ ডলারে নামে।

নিম্নমুখী পরিস্থিতিতে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সমালোচনায় পড়ে সরকার। এতে আগস্টেই জ্বালানি তেলের দাম সামান্য কমানো হয়। তবে এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশে আর কমানো হয়নি তেলের দাম। এর মধ্যে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি তুলে দেয়ার শর্ত দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণের শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তেলের দাম প্রতি মাসে সমন্বয়ের শর্ত দেয় সংস্থাটি।

আইএমএফের পরামর্শে নীতিমালা করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি সরকার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে বিপিসির মুনাফা বা লোকসান প্রায় শূন্য পর্যায়ে নেমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও ১০ শতাংশ মুনাফা দাবি করেছে বিপিসি। এতে আগের মতোই জনগণের পকেট কেটে মুনাফার পরিকল্পনা করছে সংস্থাটি, যা নিয়ে এরই মধ্যে আপত্তি উঠেছে।

গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেকটা হ্রাস পাওয়ায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর বড় অঙ্কের মুনাফার দেখা পায় বিপিসি। সে অর্থবছর সংস্থাটি মুনাফা করে চার হাজার ২১২ কোটি দুই লাখ টাকা। যদিও এর আগে টানা ছয় অর্থবছর লোকসান করেছিল বিপিসি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরও কমায় পরের অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছর বিপিসির মুনাফা বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪৪ শতাংশ।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী থাকায় সংস্থাটির মুনাফার একই ধারা অব্যাহত থাকে পরের অর্থবছরও। এতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর বিপিসির মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর মুনাফা বৃদ্ধির হার ছিল ৩২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তবে উচ্চ মুনাফার পরও দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম না কমানোয় সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এতে অনেকটা বাধ্য হয়ে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয় ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল।

এর প্রভাবে পরের অর্থবছর বিপিসির মুনাফা কিছুটা হ্রাস পায়। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিপিসির মুনাফা দাঁড়ায় ছয় হাজার ৫৩৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এতে বিপিসির মুনাফা আরও হ্রাস পায়। ফলে ২০১৮-১৯ অর্থবছর সংস্থাটি মুনাফা করে তিন হাজার ৯৮০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এরপর বিশ্ববাজারে তেলের দাম খুব বেশি ওঠানামা করেনি।

যদিও করোনা সংক্রমণ শুরুর পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবার নিম্নমুখী হতে শুরু করে। এতে বিপিসির মুনাফা বাড়তে থাকে। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর সংস্থাটি মুনাফা করে পাঁচ হাজার ৬৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০২০ সালের মাঝামাঝি বিশ্ববাজারে তেলের দাম রেকর্ড পর্যায়ে নামে। এর প্রভাবে বিপিসির মুনাফা বাড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছর লোকসান করে সংস্থাটি।

 

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০