৯ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ২৯ হাজার কোটি টাকারোহান রাজিব: চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ছয়টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ৯টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা; যা গত জুন শেষে আট ব্যাংকে ছিল ২৬ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ২ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
ব্যাংকগুলো হলো অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও মধুমতি ব্যাংক।
নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর মুনাফা কিংবা শেয়ারহোল্ডার মূলধন থেকে একটি অংশ আলাদা করে রাখতে হয়, যাকে প্রভিশন বলা হয়। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে ব্যাংকগুলোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। আর প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে যায়। বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরন অনুযায়ী দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। আর খেলাপি ঋণের প্রথম পর্যায় ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ ঋণে রাখতে হয় ২০ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায় বা ‘ডাউটফুল’ ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ৫০ শতাংশ। আর ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় শতভাগ।
জানা যায়, কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ২৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। তবে এ ঘাটতি জুনের তুলনায় অনেক বেশি। জুন শেষে সার্বিক ঘাটতি ছিল ২১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার কথা ছিল। তবে সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা।
নিয়মানুযায়ী প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারে না। আবার ঘাটতি থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ওই ব্যাংকের চার্জ বেশি লাগে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ছাড় দিয়ে আর্থিক বিবরণী ভালো দেখানোর সুযোগ দিচ্ছে। প্রভিশন ঘাটতি থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে বিলম্বে ঋণ পরিশোধ বাকা ডেফারেল সুবিধার কারণে আর্থিক বিবরণীতে দেখাতে হচ্ছে না। এতে করে বিনিয়োগকারী, আমানতকারী এবং শেয়ারহোল্ডাররা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকটির আসল চিত্র জানতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গত বছর ১৬টি ব্যাংক বিশেষ সুবিধা নিয়েছে, যা ডেফারেল সুবিধা হিসেবে বিবেচিত। এর আওতায় ব্যাংকগুলোকে মুনাফার হার ঠিক রাখতে প্রভিশন সংরক্ষণে বাড়তি সময় দেয়া হয়। গত বছর ১৬টি ব্যাংক বিভিন্ন মেয়াদের জন্য এ ডেফারেল সুবিধা পেয়েছে। ব্যাংকভেদে এক থেকে ৯ বছরের জন্য ৪৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের। বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে বেশ আলোচিত এই ব্যাংকটি। তাই অন্যদের তুলনায় আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ আদায় বেশ পিছিয়ে পড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশনের রাখার দরকার ছিল ১৫ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি মাত্র এক হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা রাখতে সক্ষম হয়। যার ফলে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ১৩ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন ঘাটতির প্রায় ৪৮ শতাংশই ব্যাংকটির।
ঘাটতির দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়ায় চার হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১৬ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৪ শতাংশেরও বেশি। এরপরেই রয়েছে বেসিক ব্যাংক। এ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় চার হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১৯৮ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫৪২ কোটি, ঢাকা ব্যাংকের ৩৯৯ কোটি, এনসিসি ব্যাংকের ৩৩৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৩৪ কোটি এবং মধুমতি ব্যাংকের ৯০ লাখ টাকা। এ ব্যাংকটি নতুন করে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। অনেকে প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে এসেও ফিরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে এলসি খুলতে না পারলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে ব্যবসা করবে। ব্যবসা করতে না পারলে তো ব্যাংকঋণ পরিশোধ করবে না। ঋণ পরিশোধ না করার কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে মূলধনে গিয়ে সরাসরি হিট করে। তাই ডলার রেট বাজারভিত্তিক করে ব্যাংকগুলোকে এলসি ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া উচিত। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।