সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের ইস্পাত খাতের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বিএসআরএম। ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) এ গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত বিক্রয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে তিন হাজার ৬০২ কোটি টাকা বা ৪৯ শতাংশ। একইভাবে আগের বছরের তুলনায় ৯ মাসে নিট মুনাফা কমেছে ১১১ কোটি টাকা বা ৪১ শতাংশের বেশি।
যদিও এ সময়ে কোম্পানি দুটির পরিচলন ব্যয়, বিক্রয় ও বিপণন ব্যয় এবং আর্থিক ব্যয় আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। পুঁজিবাজারের নিবন্ধিত ইস্পাত খাতের দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিলস রি-রোলিং মিলস লিমিটেড এবং বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের প্রকাশিত তিন প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
সূত্রমতে, ইস্পাত খাতের পুঁজিবাজারের নিবন্ধিত বাংলাদেশ স্টিলস রি-রোলিং মিলস লিমিটেড এবং বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের তিন প্রান্তিক শেষে (জুলাই-মার্চ) মোট বিক্রয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রয় হয়েছিল ১০ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় বিক্রয় কমেছে তিন হাজার ৬০২ কোটি টাকার। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে উভয় কোম্পানির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৬৩ কোটি। আগের অর্থবছরের একই সময়ের নিট মুনাফা হয়েছিল ২৭৪ কোটি টাকা।
তিন প্রান্তিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও দেখা যায়, বিএসআরএম গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত পরিচালন এবং বিক্রয় ও বিপণন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৫৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছর এ ব্যয় ছিল ২২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে ৩২ কোটি টাকা। একইভাবে ঋণের সুদসহ ২০১৯-২০ অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে মোট আর্থিক ব্যয় হয়েছে ৪৬৪ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের ছিল ৪৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় আর্থিক ব্যয় বেড়েছে ২৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে মার্চ শেষে উভয় কোম্পানির মোট মজুদ পণ্য ছিল দুই হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৬১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মজুদ বেড়েছে এ সময়ে। আর ৯ মাসের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ (স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ) ছিল ছয় হাজার ৬৯২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল সাত হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির ঋণও বেড়েছে।
ইস্পাত খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়া আগে থেকে দেশের ইস্পাত বিক্রয় ছিল নি¤œমুখী। দেশে চলমান উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি শ্লথ। আর করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রকল্পগুলো মুখ থুড়বে পড়ে আছে। ফলে বাজারে চাহিদার কয়েক গুণ বেশি ইস্পাত সরবরাহ আছে। এতে বড় কোম্পানিগুলো ভালো চাপে আছে। এক্ষেত্রে ছোট কোম্পানিগুলো ভালো আছে। কারণ তাদের উৎপাদন কম। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের ইস্পাতের বাজার নি¤œগতিতে আছে। আর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে উৎপাদন খাতে মন্দার আভাস দিয়েছেন পৃথিবীর বড় বড় গবেষণা সংস্থাগুলো।
এ বিষয়ে বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হোসাইন আকবর আলী শেয়ার বিজকে বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের তিন প্রান্তিক শেষে আগের অর্থবছরের তুলনায় আমাদের বিক্রয় ও নিট মুনাফা কমেছে। শুধু আমাদের নয়, সব ইস্পাত কোম্পানিগুলোর একই অবস্থা। মূলত সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, বেসরকারি খাতে নির্মাণ খাতে স্থবিরতা ইত্যাদি কারণে সার্বিকভাবে বিক্রয় কমেছে। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) তো লোকসানই হবে।
তিনি আরও বলেন, এখন তো বাজেট পাস হয়েছে। এখন সরকারকে বিপর্যস্ত অর্থনীতি টেনে তুলতে হবে। আর সরকার তো উৎপাদন খাতে বড় ক্রেতা। সুতরাং সরকারকে মেগা প্রকল্পসহ সব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পুরোদমে চালু রাখতে হবে। এতে অর্থ প্রবাহ ঠিক থাকবে। এখন উৎপাদক, ঠিকাদার, শ্রমিক অর্থাৎ সবার কাছে টাকার দরকার আছে। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থছাড় করতে হবে। তা না হলে তো প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি থেমে যাবে। এসব প্রকল্পের ঠিকাদারদের কাছে আমাদের অনেক টাকা আটকে আছে। আর অন্যদের কাছ থেকে আস্তে আস্তে পাওনা টাকা আসছে।
এখন তো করোনার প্রকোপ কমেনি আর সঙ্গে বর্ষাও আছে। ফলে আগামী ছয় মাস কেমন হতে পারেÑএমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন মোটামোটিভাবে সবকিছু চালু হয়েছে। কিছু কিছু কাজ চলছে। তবে বর্ষায় তো স্বাভাবিকভাবে বিক্রয় কম হয়। আর সামনে ঈদও আসছে। এতে বিক্রয় কম হবে। এ সময়টাই সেল ডাউন যাবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ইস্পাতের বৈশ্বিক মূল্য পূর্বাভাস দেন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিচ সলিউশন ম্যাক্রো রিসার্চ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এবার ধাতুটির দাম আরও কমে আসবে এবং দরপতনের এ ধারা আগামী কয়েক বছর অব্যাহত থাকতে পারে। মূলত মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, কভিড-১৯-এ প্রভাবের জেরে ক্রমেই শ্লথ হয়ে আসা বৈশ্বিক অর্থনীতি এর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এ সময়ে বিশ্বব্যাপী পণ্যটির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তবে দুর্বল অর্থনীতি ও নির্মাণশিল্পে মন্দার কারণে ধাতুর ব্যবহার কমে আসবে। ফলে চাহিদা অনুপাতে বিশ্ববাজারে ইস্পাতের সরবরাহ বেড়ে যাবে, যা পণ্যটির মূল্য কমিয়ে আনতে পারে। একই আভাস দিয়েছে ওয়ার্ল্ড স্টিল অ্যাসোসিয়েশনও।