ইসমাইল আলী: জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দুই বছর ধরে বেড়ে চলেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। এতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। সে ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাহিদাও বেড়েছে। তবে গত অর্থবছর থেকেই চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভর্তুকি বকেয়া পড়েছে প্রায় ৩৩ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা।
ভর্তুকির এ বকেয়া গত এপ্রিল (আংশিক) থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর প্রভাব পড়েছে পিডিবির আর্থিক অবস্থার ওপর। বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে সংস্থাটি। ফলে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জন্য পিডিবি ভর্তুকি চেয়েছে ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও তার পুরোটা ছাড় করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। এ পর্যন্ত ভর্তুকি ছাড় করা হয়েছে ১৮ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। আর বকেয়া রয়েছে ১১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে এপ্রিলের (আংশিক) বকেয়া দুই হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। ওই মাসের দুই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ছাড় হয়েছে। এছাড়া মে ও জুনের পুরোটাই বকেয়া রয়েছে। এর পরিমাণ যথাক্রমে তিন হাজার ৮২৩ কোটি ও চার হাজার ৯৭০ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য সম্ভাব্য ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বকেয়া পড়েছে ২২ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এ ছয় মাসের মধ্যে জুলাইয়ে ভর্তুকি দরকার ছিল চার হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, আগস্টে চার হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে চার হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা, অক্টোবরে তিন হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, নভেম্বরে তিন হাজার ১৯৫ কোটি টাকা এবং ডিসেম্বরে এক হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা।
এর বাইরে চলতি অর্থবছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ভর্তুকির সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে প্রয়োজন হবে দুই হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারিতে দুই হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা, মার্চে তিন হাজার ৮২৭ কোটি টাকা, এপ্রিলে চার হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা, মে মাসে তিন হাজার ৭৭১ কোটি টাকা এবং জুনে দরকার হবে চার হাজার ৭৪১ কোটি টাকা।
পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে ভর্তুকির অর্থ নিয়মিত ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে পিডিবি। অর্থ ছাড়ের যে অবস্থা তাতে জমে থাকা বকেয়া ছাড় হতে হতে
চলতি অর্থবছর শেষ হয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
চলতি অর্থবছর ছাড়াও আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ভর্তুকির সম্ভাব্য প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। এতে দেখা যায়, আগামী অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে ভর্তুকি লাগবে ২২ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাইয়ে ভর্তুকি লাগবে চার হাজার ১৯ কোটি টাকা, আগস্টে চার হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে চার হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, অক্টোবরে চার হাজার সাত কোটি টাকা, নভেম্বরে তিন হাজার ৬৮ কোটি টাকা এবং ডিসেম্বরে তিন হাজার ৮৬ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩৮০ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। সঞ্চালন লোকসান বাদ দিয়ে বাল্ক (পাইকারি) গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা হয় দুই হাজার ৩০৯ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ৩৪ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। আর সে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। এতে লোকসান হয় ২২ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এ অর্থই ভর্তুকি হিসেবে চাওয়া হয়েছে।
এদিকে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্য পরিমাণ ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬০২ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। সঞ্চালন লোকসান বাদ দিয়ে বাল্ক গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা হবে দুই হাজার ৫২৪ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। আর সে বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে সম্ভাব্য আয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এতে লোকসান দাঁড়াবে ২১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এ অর্থই ভর্তুকি হিসেবে দরকার হবে।
উল্লেখ্য, গত অর্থবছর পিডিবি বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয় করে ৪১ হাজার ৬৩৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অন্যান্য আয় যোগ করে মোট আয় দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৫৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর সংস্থাটি ব্যয় ছিল (উৎপাদন ও পরিচালনা) ৭৩ হাজার ৬৫১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এতে পিডিবির নিট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৫৯৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের ভর্তুকি দেয়ার কথা ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যার পুরোটা এখনও ছাড় হয়নি।