করোনার প্রভাব নেই

৯ মাসে ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশি ঋণ পরিশোধ

শেখ আবু তালেব: বিদেশি ঋণের দুয়ার উম্মক্ত হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছেন এদিকে। দেশীয় ঋণ পরিশোধে অনিয়মিত হলেও নির্দিষ্ট সময়ে তারা ঠিকই পরিশোধ করছেন বিদেশি ঋণের অর্থ। করোনা মহামারির বছরেও ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি উৎসের ঋণ ব্যবস্থায় একটি ডিসিপ্লিন মানা হয়, কিন্তু দেশীয় ঋণ ব্যবস্থাপনার বাজারটি স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। এজন্য দেশীয় উদ্যোক্তারা করোনাকালেও বিদেশি ঋণ পরিশোধে সজাগ রয়েছেন।

এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এমন তথ্য। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ এই ৯ মাসে ব্যবসায়ীরা ১১৬ কোটি ২৭ লাখ ডলার পরিশোধ করেছেন, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৯ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা দরে)। এর মধ্যে এক হাজার ১৩ কোটি টাকা আছে সুদ হিসেবে। অবশিষ্ট আট হাজার ৮৭০ কোটি টাকা তারা আসল হিসেবে পরিশোধ করেছেন বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ও দেশগুলোকে।

জানা গেছে, পরিশোধিত অর্থের মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে তিন হাজার ৫২৮ কোটি ৯৪ লাখ, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তিন হাজার ১৫২ কোটি ৪৮ লাখ ও জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তিন হাজার ২০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়।

জানা গেছে, করোনা মহামারির বছর হিসেবে পরিচিত ২০২০ সালে দেশীয় ব্যাংক খাত থেকে একের পর এক সুবিধা নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে অনেক খাতে বিশেষ করে খাদ্য ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা ভালো করেছেন। কিন্তু তার প্রভাব দেখা যায়নি ব্যাংক ঋণ পরিশোধে। যদিও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কোনো ব্যবসায়ী চাইলে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারবেন।

বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের আন্তরিকতার বিষয়ে কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মানসুর। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিদেশি কোনো ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান একবার খেলাপি হলে আর ঋণ পাবে না। এমনকি বিদেশি ঋণ থাকা অবস্থায় অন্য প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নেয়া সহজ নয় কোনো প্রতিষ্ঠানের। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেয়ার সময়ে গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, ক্রেডিট রেটিং ও গ্রহণযোগ্য নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে কি না, তাও যাচাই করে দেখে। তারা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে একটি ডিসিপ্লিন দেখে। ঋণ বিতরণ ও আদায়ের একটি সংস্কৃতি তারা গড়ে তুলেছে। প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও জরিমানা এড়াতে বিদেশি ঋণের অর্থ পরিশোধে সবসময়ই সজাগ থাকেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।’

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ঋণ সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ঋণগ্রহীতারা বছরের পর বছর সুবিধা নিয়ে চলেছেন। খেলাপিরা একই ঋণ পুনঃতফসিল করছেন একাধিকবার। নিচ্ছেন সুদ মওকুফ সুবিধা। এটি করতে গিয়ে অর্থনৈতিক ও ক্ষেত্র বিশেষে রাজনৈতিক প্রভাবও বিস্তার করে থাকেন। এটি করতে গিয়ে আমাদের ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। আর্থিক বাজার স্বাভাবিকভাবে পরিচালন হচ্ছে না। এর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি সরকারেরও রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।’

বাংলাদেশে ঋণসুদ হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় বছর পাঁচেক আগে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম দিকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা নিলেও এখন সব খাতের উদ্যোক্তারই নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বর্তমানে বিদেশি সংস্থার পাশাপাশি দেশীয় ব্যাংকের অফশোর ইউনিট থেকেও ঋণ নিচ্ছেন, যা বিদেশি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

বিদেশি উৎসের ঋণের কারণে কিছুটা চাপও তৈরি হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রা বাজারে। বিদেশি উৎস থেকে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধের সময় বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ওপর চাপ পড়ে। অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, ঋণ নেয়ার সময় ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার সাধারণত কম থাকে। কিন্তু পরিশোধের সময় তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এতে ব্যবসায়ীদেরও সমস্যা হয়।

অর্থনীতিতে বিদেশি ঋণ কতটা ঝুঁকি তৈরি করছে, তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। ‘প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব শর্ট টার্ম ফরেন কারেন্সি ফিন্যান্সিং অব ব্যাংকস’-এর ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ব্যাপকহারে বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান এ ঋণ বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ঋণের এ লাগাম টেনে ধরতে না পারলে দিনে দিনে তা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এরই মধ্যে এ ধরনের ঋণের দ্বারা অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেননা পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। এজন্য বিষয়টি নিয়ে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।

বৈশ্বিকভাবে দেখলে, ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস হওয়া দেশগুলোয় কম খরচের স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলো পরে বড় করা হয়। এজন্য বিদেশি ঋণগ্রহীতাদের দেশীয় ঋণ পরিশোধের চিত্র কেমন তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়ে সময়ে দেখা প্রয়োজন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০