ব্যবসার শুরুতে যে বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন

গতকালের পর…….

 

ড. শাহ এমরানঃ কোনো সদস্যের অক্ষমতা ও মৃত্যুজনিত কারণে ব্যবসার অস্তিত্ব বজায় থাকে এবং স্থিতিশীল থাকে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠান। তা সত্ত্বেও এ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কিছু অসুবিধাও আছে। এগুলো হলোঃ

এক. যদি কোনো সদস্য প্রতারণা করেন বা ব্যবসায় মনোনিবেশ না করেন, তবে মতভিন্নতা দেখা যায় এবং ব্যবসা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে; দুই. ব্যবসার বণ্টন নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লাগতে পারে; তিন. আর্থিক সম্পদ তুলনামূলকভাবে সীমিত; চার. একান্নবর্তী থাকা না থাকার ওপর ব্যবসার স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বশীলতা নির্ভর করে।

অংশীদারি কারবার: যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি অর্থ, শ্রম ও দক্ষতা এবং মুনাফা ও ক্ষতি সমভাবে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানসে একত্র হয়ে কোনো ব্যবসা শুরু করেন, তখন ওই ব্যক্তিদ্বয়ের বা ব্যক্তিবর্গকে অংশীদার এবং পুরো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডটিকে অংশীদারি কারবার নামে অভিহিত করা হয়। অংশীদারি আইন, চুক্তি আইন ও কোম্পানি আইন মোতাবেক অংশীদারি কারবারের বিধিবিধানগুলো নির্ধারিত হয়। একক মালিকের আর্থিক অসচ্ছলতা, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, জনবলের অভাব ও সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে অংশীদারি কারবারের উৎপত্তি হয়। ব্যক্তিদের মধ্যে আইনগত চুক্তির মাধ্যমে এই ব্যবসা শুরু হয়। আর এই চুক্তি মৌখিক বা লিখিত হতে পারে। লিখিত চুক্তিকে ‘অংশীদারি চুক্তি’ বলে। চুক্তির শর্ত মতে, কোনো অংশীদার তার অংশ অন্য অংশীদারকে না জানিয়ে বাইরের কারও কাছে বিক্রি করতে বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। ব্যবসার মুনাফা ও ক্ষতি অংশীদারদের মধ্যে চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী বণ্টিত হবে।

অংশীদারি কারবারের সুবিধা

১. অংশীদারি কারবার শুরু করা সহজ। দুই বা ততোধিক সমমনা ব্যক্তি একত্র হয়ে এটি করতে পারে। মৌখিক বা লিখিত চুক্তির ভিক্তিতে এটি শুরু করা যায়। আইনগত জটিলতাও কম। ২. অংশীদাররা নিজস্ব অর্থ সম্পদ একত্র করে এটি শুরু করতে পারেন এবং ঐকমত্যের ভিক্তিতে বিভিন্ন উৎস থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে পারেন। ৩. অভিজ্ঞ অংশীদাররা ব্যবসার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। ৪. অল্প সময়ের নোটিসে একত্র হয়ে অংশীদাররা যে কোনো বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ৫. ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব। ৬. অংশীদাররা দক্ষ, অভিজ্ঞ ও উৎসাহী হলে দ্রুত ব্যবসার সম্প্রসারণ ও প্রভূত উন্নতি সাধন সম্ভব। কেননা এত সবাই মিলে বেশ বড় আকারের মূলধন নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে, কাজের ধরন বুঝে কাজ ভাগ করে নিতে পারেন, উত্তম পরিচালনা ব্যবস্থা বহাল করে ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারেন। ৭. লোকসান হলে এটা সবাই সমানভাবে বণ্টন করে নেবেন। ৮. কোনো একজন অংশীদার ইচ্ছা

করলে বা অতি দরকারে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারেন। ৯. অংশীদাররা সৎ ও নিষ্ঠাবান হলে বেশি মুনাফা অর্জন সম্ভব।

অংশীদারি কারবারের সীমাবদ্ধতা

১. অংশীদারি কারবারে খুব বড় আকারের ব্যবসা শুরু ও পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কেননা অংশীদারের সংখ্যা ২০ জনের বেশি হবে না। ফলে বড় আকারের মূলধনও সংগ্রহ সম্ভব নয়। ২. অংশীদারদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও সমন্বয়হীনতার কারণে এ ধরনের ব্যবসা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ৩. যদি কোনো অংশীদার অতি অল্প সময়ে নোটিসে ব্যবসা ছেড়ে দিতে চান আর অন্য অংশীদাররা সেটা কিনতে না পারেন, তবে ব্যবসাটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ৪. সব অংশীদারের সম্মতি ছাড়া কোনো একজন অংশীদার তার মুনাফা বা মূলধন বাইরের কাউকে হস্তান্তর করতে পারেন না। ৫. অসাধু বা অযোগ্য অংশীদারের ক্ষেপামীর কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ৬. অংশীদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট গোপন থাকে বলে এবং এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে সাধারণ মানুষ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখতে পারে না এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে বা ধারে পণ্য ও সেবা সামগ্রী দিতে অনীহা বোধ করে। ৭. এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হলে পাওনাদাররা অংশীদারের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করে পাওনা আদায় করতে পারে না। আর এটাই অংশীদারি কারবারের সবচেয়ে বড় অসুবিধা।

অংশীদারি কারবারের প্রকারভেদ: অংশীদারি কারবারের অংশীদাররা কয়েক শ্রেণির হতে পারে। এগুলো হলো ১. সক্রিয় বা কর্মরত অংশীদার, ২. ঘুমন্ত বা নিষ্ক্রিয় অংশীদার, ৩. নামমাত্র অংশীদার, ৪. শুধু মুনাফাভোগী অংশীদার, ৫. গোপন অংশীদার ৬. দালাল শ্রেণির অংশীদার, ৭. নামকাওয়াস্তে অংশীদার ও ৮. অপ্রাপ্ত বয়স্ক অংশীদার।

প্রতিষ্ঠানের অংশীদারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে

ধরা হলোঃ

সক্রিয় বা কর্মরত অংশীদার: সক্রিয় বা কর্মরত অংশীদার হলেন তিনি, যিনি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মূলধন সংগ্রহেও তিনি অংশ নেন। কাজের ধরন ও চুক্তির ধরন অনুযায়ী তাকে নির্দিষ্ট হারে সম্মানী প্রদান করা যেতে পারে। বাস্তবিক অর্থে এমন অংশীদারই ব্যবসার মূল ব্যক্তি হিসবে পরীগণিত হন।

ঘুমন্ত বা নিষ্ক্রিয় অংশীদার: প্রতিষ্ঠানের মূলধন বা পুঁজি সংগ্রহে অংশ নেন কিন্তু দৈনন্দিন কাজে অংশ নেন না। তারাই ঘুমন্ত বা নিষ্ক্রিয় অংশীদারর। এসব অংশীদাররা মুনাফা ও ক্ষতি দুটোই ভোগ করেন। আবার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে ও ভূমিকা রাখতে পারেন, কিন্তু অংশীদার হিসেবে জনসমক্ষে তাদের নাম প্রকাশ করা হয় না।

নামমাত্র অংশীদার: এ ধরনের অংশীদাররা পুঁজি গঠন ও দৈনন্দিন কাজে অংশ নেন না। শুধু নাম ও খ্যাতিকে কাজে লাগানোর জন্য তার নাম যুক্ত করা হয়। একজন নামমাত্র অংশীদার লাভ ভোগ করে না কিন্তু দেনার দায় নিতে হয়।

মুনাফাভোগী অংশীদার: এ ধরনের অংশীদাররা শুধু মূলধন বা পুঁজি গঠনে অংশ নেন এই মর্মে যে, তারা শুধু মুনাফা ভোগ করবেন কিন্তু ক্ষতির অংশ নেবেন না। তবে তারা পাওনাদারদের কাছে দায় মেটাতে দায়ী থাকবেন। এ ধরনের অংশীদাররা শুধু তাদের টাকা ও সুনাম ব্যবসার কাজে লাগানোর জন্য অংশীদার হয়ে থাকেন।

গোপন অংশীদার: এ ধরনের অংশীদাররা ব্যবসার অংশীদার হলেও বাইরের কাউকে জানতে দিতে

চান না যে তিনি অংশীদার। এরা ব্যবসা

পরিচালনার কাজে অংশ নিতে পারেন এবং দায়-দেনারও অংশ নেন।

দালাল শ্রেণির অংশীদার: এরা পুঁজি গঠন বা ব্যবস্থাপনায় অংশ নেন না কিন্তু বাইরের

মানুষের কাছে এমন ধারণা দেন যেন তারা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। তাদের আচার-আচরণের বাইরের মানুষের তাদের ওপর আস্থা রেখে প্রতিষ্ঠানে ধার নিতে বাধ্য।

নামকাওয়াস্তে অংশীদার: যখন কোনো ব্যক্তির নাম অংশীদার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন না, তখন তাকে নামকাওয়াস্তে অংশীদার বলে। তারাও কোম্পানির দায় নিতে বাধ্য।

অপ্রাপ্তবয়স্ক অংশীদার: বয়স আঠারোর নিচে হলে ওই অংশীদারকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক অংশীদার বলে। সবার সম্মতিতে সে সদস্য হিসেবে গণ্য হবে এবং ব্যবসায় সম্পদ ও লভ্যাংশ ভোগ করতে পারবে।

অংশীদারিত্বের প্রকারভেদ

অংশীদারিত্ব দুই ধরনের। যথা ১। সাধারণ অংশীদারিত্ব ২। সীমিত অংশীদারিত্ব

সাধারণ অংশীদারিত্ব: যে অংশীদারিত্বে অংশীদারদের দায়-দেনার পরিমাণ অসীম এবং কোনো কারণে প্রতিষ্ঠানের দেনার পরিমাণ মূলধনের চেয়ে বেশি হলে পাওনাদররা অংশীদারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তা আদায় করতে পারবেন তাকে সাধারণ অংশীদারিত্ব বলে। প্রতিষ্ঠানের সব

অংশীদার সমানভাবে ব্যবস্থাপনার কাজে অংশ নিতে পারবেন। (চলবে……)

 

অধ্যাপক, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০