ড. এমএ মজিদ
বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলায় পড়েছি ব্যাঙ ও মশার জীবনচক্র। বর্ষাকালে ব্যাঙ ডিম ছাড়ে, সে ডিম থেকে বের হয় ব্যাঙাচি। এ ব্যাঙাচি বড় হয়ে ব্যাঙ হয়ে যায়। বর্ষাকালে এখন আর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক তেমন শোনা যায় না। কেনই বা শোনা যাবে? মুরব্বিরা বলেন, আগের মতো নাকি বর্ষাকালে আর বৃষ্টি হয় না। খাল-বিলও ভরে না। তাই ব্যাঙও ডিম ছাড়ে না। ব্যাঙাচিও জš§ নেয় না।
তাঁতির বাড়ী ব্যাঙের বাসা কোলাব্যাঙের ছা, খায় দায় গান গায় তাই রে নাই রে না। ব্যাঙ নেই ব্যাঙের ডাকও নেই। তাই এখনকার ছড়াকাররা ব্যাঙ নিয়ে আর ছড়া লেখেন না। কবিদের কবিতায়ও ব্যাঙের জায়গা হয় না।
পরিবেশের ওপর আমাদের অত্যাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিরীহ প্রাণী ব্যাঙ আর ব্যাঙাচির জন্ম দেয় না। উপকারী এ প্রাণীটি পরিবেশের ভালো বন্ধু ছিল। ক্ষেত-খামারের পোকামাকড় খেয়ে ফসল রক্ষা করত। ব্যাঙ নেই, তাই আমরা পোকামাকড় মারতে বিষ ব্যবহার করি। খাদ্য হিসেবেও নাকি ব্যাঙের গোশত ভালো। চীনাদের পছন্দ, তবে আমরা বাঙালিরা খাই না।
ব্যাঙ নিয়ে অনেক কথা হলো। এবার মশা প্রসঙ্গে আসি। কেউ কি ভেবে দেখেছেন, সোনার বাংলার প্রতিটি ঘরের আনাচ-কানাচে এ পতঙ্গের এত বিস্তার কেন? যে হারে এ পতঙ্গের বংশবিস্তার হচ্ছে, তাতে করে এ ছোট দেশটি হয়তো বাঙালির হাতছাড়া হয়ে যাবে। হয়ে যাবে মশকদেশ! তিলোত্তমা ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরীর পিতাগণ মশক নিধনে কামান দাগেন। কিন্তু কিছুই হয় না। তাই বেরসিক সমালোচকরা সমালোচনা করেন। সাংবাদিকরা খবর তৈরি করেন। কোটি টাকার মশার ওষুধ ছিটানো হলো। একটি মশাও মরল না। মানে ওটা নাকি ভেজাল। গ্রামের মেম্বার-চেয়ারম্যান এই অভিযোগ থেকে মুক্ত। কারণ তাদের নাকি মশক নিধনের বরাদ্দ নেই। তাই জনগণের বকাও খেতে হয় না।
একবার ভাবুন তো, একসময়কার ম্যালেরিয়া সৃষ্টিকারী মশক সময়ের বিবর্তনে কীভাবে ডেঙ্গু মশক হয়ে গেল? কারা এর জন্য দায়ী। আমরা নাকি মশকরা? নাকি বাঙালি মশক ভাই ভাই, একে ছাড়া অন্যের গতি নেই। কথায় আছে, বাঙালি যেখানে খায় সেখানেই মলত্যাগ করে। খাবারের উচ্ছিষ্ট ও ময়লা পানি রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে। রাঁধুনিও আনন্দ পেলো, ময়লা ফেলার কষ্ট করতে হলো না। অন্যদিকে মশক-মাছিও আনন্দে ওড়াউড়ি শুরু করে মজাদার খাবার ও প্রজননবান্ধব পরিবেশ পেয়ে। ভেজাল বাঙালির ভেজাল কাজ। কাজ নেই তো খৈ ভাজ।
বাঙালি কি আসলেই ভেজাল? বিজ্ঞানীরা হয়তো ভবিষ্যতে বাঙালির জেনোটাইপিক গঠনতত্ত্ব উদ্ভাবন করবেন। তখন হয়তো জানা যাবে অস্থির বাঙালির অস্থিরতার কারণ। বাঙালির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য বিশ্ববাসীর জানা। এই ফুস, এই ঢুস। কাজের কাজে নেই, আছে অকাজের ভাজে। তবে ফেনোটাইপিক গঠনে বাঙালি ককেশীয়, দ্রাবিড়, মঙ্গোলিয়ান প্রভৃতির সংমিশ্রণ। মানে সংকর বা হাইব্রিড। খাস বাংলায় বললে ভেজাল। ‘হাইব্রিড’ শব্দটি এ মুহূর্তে বেশ পপুলার। রাজনীতিতে একই পক্ষ নিজেদের মধ্যে পরস্পরকে ঘায়েল করতে শব্দটি ব্যবহার করে। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলে নাকি সুযোগসন্ধানী অন্য দলের নেতাকর্মী ঢুকে পড়ে। তারা পুরোনোদের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধায় ভাগ বসায়। তখন পুরোনোরা নবাগতদের ‘হাইব্রিড’ নামে গাল দেয়। মোদ্দাকথা হলো, হাইব্রিডরা ভেজাল। ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনের জন্য সময়ের পরিক্রমায় এ-দল থেকে ওই-দলে ভিড় জমায়।
রাজনীতির রাজনৈতিকতায় হাইব্রিড বা ভেজাল সমস্য যেমন প্রকট, সমাজের সামাজিকতায় ও সংস্কৃতিতেও হাইব্রিডের বা ভেজালের সমস্যা তেমন প্রকট। হিন্দি সিনেমার গান ছাড়া বাঙালির বিয়ের অনুষ্ঠান জমে না। গায়েহলুদে তরুণীদের হিন্দি নাচ না হলে হলুদের রং নাকি হলুদ হয় না। তাই হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, চিরায়ত বাংলার এ গান তরুণীদের কণ্ঠে বাজে না। ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ গান ছাড়া চলে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের র্যাগ ডেতে মাখামাখি ও বিদেশি ভাষার গান ছাড়া চলে না। উš§ুক্ত পিকআপভ্যানে সাউন্ড সিস্টেমের বিকট আওয়াজে ‘চলি ক্যা পিছে ক্যায়া হে’ গান আর পেছনে উচ্চশিক্ষা শেষকারী এদেশের তরুণ-তরুণীর নৃত্তন-কুত্তন। পাশে দাঁড়িয়ে রিকশাচালকরা হাসে আর টিপ্পনী কাটেÑমামা-ভাগ্নীরা জোরে নাচ! এ যেন এক বাহারি, বিকৃত ও ভেজাল সংস্কৃতিচর্চার নগ্ন প্রয়াস। নেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা। নেই বাংলার স্বকীয়তা। পয়লা বৈশাখে তাই বাঁশের বাঁশির জায়গা নিয়েছে ভুভুজেলা। ঐতিহ্যবাহী ডুগি তবলার জায়গা নিয়েছে আধুনিক কি-বোর্ড ও ড্রাম। সংস্কৃতির এ চর্চাকে কী বলবেন?
শুধু কি বাঙালির সংস্কৃতি ও সামাজিকতায় ভেজাল ঢুকেছে? সবার আগে ভেজাল ঢুকেছে বাঙালির শিক্ষা ও মূল্যবোধে। আর এ কারণে বাঙালির জীবন এখন ভেজাল বৃত্তে আবদ্ধ। নানা ধারা-উপধারার শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করছে নানা মত ও মতাদর্শের মানুষ। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা, কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা, বাংলা মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা, আরও কত কী? আপন দুই ভাইয়ের একজন যদি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ও অন্যজনকে যদি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত করা হয়, তাহলে ভাবুন তো দুই ভাইয়ের চিন্তা, চেতনা ও চর্চায় কী বিস্তর ব্যবধান হবে? ধর্মে ও কর্মে কী ব্যবধান হবে? সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণায় কী ব্যবধান হবে? ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত ছাত্রের কাছে যেটা আধুনিকতা, মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত ছাত্রের কাছে সেটা পাপ, আর বাংলা মাধ্যমে শিক্ষিত ছাত্রের কাছে সেটা হলো অপচর্চা বা ভাঁড়ামি। শিক্ষার এ ভেজাল ব্যবস্থা যদি চলতেই থাকে, তবে সমাজে বিভাজন রেখা কি আরও প্রকট হবে না? এমনিতেই বাঙালি এখন রাজনীতির বিভাজন রেখায় প্রকটভাবে বিভক্ত। সেই সঙ্গে যদি শিক্ষাব্যবস্থা ও মূল্যবোধেও বিভাজন তৈরি হয়, তাহলে বাঙালি সব ঐতিহ্য হারাবে। বাঙালির সব শান্তি অশান্তিতে এবং সব সুখ অসুখে পরিণত হবে।
খাদ্য ও পানীয় বেঁচে থাকার নিয়ামক। সুষম খাদ্য সুস্থ রাখেÑএ কথাও বাঙালির জানা। আবার ভেজাল খাদ্য অসুস্থ করেÑএ কথাও বাঙালির জানা। বাঙালিকে ‘ভেতো বাঙালি’ বলে যেমন গাল দেওয়া হয়, আবার বাঙালি ‘ভোজনরসিক’ বলেও প্রশংসা করা হয়। ভেজাল শিক্ষা ও মূল্যবোধের কারণে বাঙালি জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের পরিবর্তে বেঠিক প্রয়োগেই বেশি পটু। তাই ভোজনরসিক বাঙালি পরস্পরকে বিষ ভোজন করাচ্ছে।
‘মাছেভাতে বাঙালি’র আজ মাছেও বিষ, ভাতেও বিষ। ফরমালিনে চুবানো মাছ দেখায় তরতাজা। খালবিলের পানিতে মাছ বিষাক্ত। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহƒত কীটনাশক, মানুষের মলমূত্র সবই আজ নদী, খাল ও বিলের পানিতে। মারাত্মক পরিবেশ দূষণের কারণে নদ-নদী, খাল-বিলের মাছ আজ বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। তার ওপর ফরমালিনের পরশ। বেশি লাভের আশায় একশ্রেণির ফড়িয়া মধ্যস্বত্বভোগী অবাধে এ বিষ মাছে প্রয়োগ করে বড় শহরগুলোতে চালান করছে। ওদিকে অটোমেটিক মেশিনে তৈরি ধবধবে সাদা চাল। চালের ওপরে এক ধরনের বাদামি আবরণ থাকে এবং এ আবরণে ভিটামিন বি থাকে। মেশিনের মাধ্যমে পলিশ করে এ আবরণ সরানোর ফলে বাঙালি এ ভিটামিনবঞ্চিত। মজার ব্যাপার হলো, এ ভিটামিন ভাত খাবার পর এর কার্বোহাইড্রেটকে হজমে সহায়তা করে। অন্যদিকে বেশি লাভের আশায় অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী চালে আবার পাথর ভেজাল মেশান। অন্যদিকে গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশ দূষণের কারণে আমাদের চালে বিষাক্ত ভারী ধাতু বিদ্যমান।
মোদ্দাকথা, আমরা ভেজালের জালে এমনভাবে আটকে গেছিÑবের হওয়ার আর সহজ উপায় নেই। সবজিওয়ালার সবজিতে ভেজাল, দুধওয়ালার দুধে ভেজাল। সবজিওয়ালা মাছওয়ালাকে ভেজাল খাওয়াচ্ছে। মাছওয়ালা সবজিওয়ালাকে, দুধওয়ালা চালওয়ালাকে ভেজাল খাওয়াচ্ছে, চালওয়ালা দুধওয়ালাকে। সারকথা, সবজিওয়ালা, দুধওয়ালা, চালওয়ালা, মাছওয়ালা, তেলওয়ালা, ওষুধওয়ালা, মুরগিওয়ালা, খামারওয়ালা, রেস্তোরাঁওয়ালা, মিলওয়ালা সবাই সবাইকে ভেজাল ও বিষ খাওয়াচ্ছি। সবাই আমরা সাময়িক লাভের বৃত্তে আবদ্ধ। কেউই ভাবছি না ভবিষ্যৎ ও ভবিষ্যৎ প্রজš§ নিয়ে। বাঙালি এত বুদ্ধিমান ও চতুর যে, সব সময় শর্টকাট রাস্তা পছন্দ করে। কিন্তু বাঙালির বুদ্ধি যে কাকের বুদ্ধির মতো। কাক নাকি চোখ বন্ধ করে খাবারের হাড্ডি লুকায়, কেউ যেন না দেখে। তবে কাকেদের মধ্যে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও মমত্ব অসাধারণ, যা বাঙালির মধ্যে নেই।
বাঙালি কাকের মতো চোখ বন্ধ করে আছে। নিজের লাভ ষোলোআনা, এই হিসাবে আছে। তাই দুধওয়ালা অনায়াসে ডিমওয়ালাকে, ডিমওয়ালা অসংকোচে মাছওয়ালাকে ভেজাল খাওয়াচ্ছে। ভেজাল খেয়ে মাছওয়ালা, দুধওয়ালা, সবজিওয়ালা, ডিমওয়ালা সবারই বংশধর যে অসুস্থ হচ্ছে, রুগ্ণ হচ্ছে, সে খেয়াল নেই। মাছওয়ালা ছেলের সঙ্গে যে দুধওয়ালার মেয়ের বিয়ে হবে না, এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? কিংবা ওষুধওয়ালার সঙ্গে খামারওয়ালার যে আত্মীয়তা হবে নাÑকে বলতে পারে? আমরা বাঙালিরা জেনেশুনে আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছি। সবাই আমরা সাময়িক লাভের খরগোশ দৌড়ে আছি। এ কি আমাদের অজ্ঞতার কারণে, নাকি সুশিক্ষার অভাবের কারণে? বিশাল জনসংখ্যার সিংহভাগ তরুণী ও যুবক। এদেরকে কি আমরা একই ভেজালের বৃত্তে আটকে রেখে যাব?
কে উদ্যোগ নেবে একটি সুশিক্ষিত ও ভেজালমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে?
অধ্যাপক, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Add Comment