আলম শামস: সাফফাতুল ইসলাম রুহিন বয়স ১০। সে এখনও ঠিকমতো খেতে পারে না। নিজের হাতে খাওয়া তো দূরের কথা, মা মুখে তুলে দিলেও চিবিয়ে খেতে পারে না। রুহিনের বাবা বলেন, জšে§র পর থেকেই রুহিন অন্য ১০টি শিশুর মতো স্বাভাবিক নয়। বয়স বাড়লেও তার স্বাভাবিক-মানসিক বৃদ্ধি ঘটেনি। সে এখন মোটামুটি হাঁটাচলা করতে পারে, কিন্তু কথা বলতে পারে না। চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছেন, রুহিনের জটিল বিকাশজনিত সমস্যা আছে। এটা এক ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার গাজীনগর এলাকায় রুহিনদের বাড়ি। তিন ভাইয়ের মধ্যে রুহিন সবার বড়। অন্য দুজন স্বাভাবিক। যত সমস্যা রুহিনকে নিয়ে। সে ঠিকমতো কথা বলতে পারে না, নিজের খাওয়াও নিজে খেতে পারে না, অন্য দশজন ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশতে পারে না। তাকে নিয়ে মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই। আমাদের আশপাশে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, অনেক পরিবারেই মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীর যে কোনো দেশের শতকরা তিন শতাংশ মানুষ মানসিক প্রতিবন্ধী।
মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের অর্থ হলো, বয়স অনুপাতে শিশুটির যে বুদ্ধি থাকার কথা, তা থাকে কম মাত্রায়। বুদ্ধি বা আইকিউয়ের পরিমাণ কতটুকু কম তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবন্ধিত্বকে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
জন্মের পর থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের হামাগুড়ি দেওয়া, হাঁটা, বসতে শেখা, দাঁত ওঠা, কথা বলা ইত্যাদি কিছুটা দেরিতে শুরু হয়। একটু বয়স হয়ে গেলেও তারা নিজেদের পোশাক নিজেরা পরতে পারে না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে না; এমনকি আকস্মিক বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। কখনও কখনও আগুন ও পানি শব্দ বলতে পারে না। বাড়ি থেকে একটু দূরে ছেড়ে দিলে একা একা ফিরে আসতে পারে না, রাস্তাঘাটে ঠিকমতো চলাচল করতে পারে না।
মানসিক প্রতিবন্ধীদের মানসিক গঠন, মস্তিষ্কের গড়ন, মস্তিষ্ক বা ব্রেনের কাজ ইত্যাদি ধীরগতিতে হয়। অন্য সাধারণ দশটি শিশু থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের কথাবার্তা, চলাফেরা, শারীরিক গঠন, আচার-আচরণ ও ব্যবহার দ্বারা সহজেই পৃথক করা যায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজিস্ট ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, সমাজের সাধারণ দশটি শিশু থেকে আচরণগত ও বিকাশগত তফাত থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শনাক্ত করা যায়। জš§গত ছাড়াও শিশুর শৈশবকালীন যে কোনো সংক্রমণ শিশুকে মানসিক প্রতিবন্ধী করে ফেলতে পারে। মানব মস্তিষ্কে এবং স্পাইনালকর্ড ঘিরে এক ধরনের আবরণী পর্দা রয়েছে, একে বলা হয় মেনিনজেস। ব্যাকটেরিয়াল, ভাইরাল এবং প্রোটোজোয়াজনিত সংক্রমণের কারণে মানব মস্তিষ্কের সেই পর্দা আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে মানব মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেলে শিশু মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। পর্যাপ্ত পুষ্টি, যা মস্তিষ্ক বা নার্ভাস সিস্টেম গঠন করার জন্য এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন, তা থেকে তারা বঞ্চিত। আমিষ, শর্করা ও স্নেহজাতীয় খাবারের স্বল্পতার জন্য অল্প বয়সে অনেক শিশুই মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়।
মানসিক প্রতিবন্ধিতার কারণ নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে, যদিও সুনির্দিষ্ট কোনো কারণকে চিহ্নিত করা যায়নি। তবে বংশগত বা জেনেটিক কারণকে অনেকেই দায়ী করে থাকেন। উইলসন্স ডিজিজ, ক্রমোজোমাল ডিজঅর্ডার; যেমন ডাউন সিনড্রোম, ফিনাইল কেটোনইউরিয়া, নিউরাল টিউবের সমস্যা; যেমন পলিজেনিক ডিজঅর্ডার, ক্লিনফেলটার্স সিনড্রোম, রুবেলা, টক্সোপ্লাজমোসিসজনিত স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কিত সমস্যা; যেমন হাইড্রোকেফালাস, মাইক্রোকেফালি ইত্যাদি মানসিক প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
মায়ের গর্ভ থেকে শিশু জন্ম নেওয়ার সময় মস্তিষ্কে কোনো ধরনের আঘাত পেলে শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। আবার অনেক শিশু রয়েছে, যারা পূর্ণতা পাওয়ার আগেই পৃথিবীর আলো দেখে। এ ধরনের শিশুদের ক্ষেত্রে শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেসব শিশু এ সমস্যায় ভোগে তাদের স্নায়ুতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে না। ফলে এরা পরে মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়।
বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও ইতিহাস পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের মূল্যায়ন করা যায়; যেমন শিশুর কর্মদক্ষতার বিশ্লেষণ, আইকিউ, পেশি শক্তির বিকাশ, শিশুর ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা, কানে কম শোনা, দৃষ্টিশক্তিহীনতা, সামাজিক বিকাশ এবং ব্যক্তিগত ও অন্যান্য শারীরিক ও সাইক্রিয়াট্রিক সমস্যার বিশ্লেষণ করে শিশুর শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধিতা নির্ধারণ করা হয়।
তাই গর্ভাবস্থায় মায়ের শারীরিক অবস্থা ও জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত শিশুর বিকাশজনিত বিভিন্ন সমস্যার বিস্তারিত ইতিহাস জানতে হয়। প্রসবকালীন জটিলতা, গর্ভাবস্থায় কোনো জটিল সমস্যা বা মায়ের কোনো বিশেষ রোগ আছে কি না, সে সম্পর্কে তথ্য নেওয়া হয়। আবার শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিভিন্ন ধাপ, জšে§র সময় মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছে কি না, মেনিনজাইটিসের মতো সংক্রামক ব্যাধি অথবা রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এমন আত্মীয়স্বজনের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক আছে কি না, এসব তথ্য শিশুর বিকাশ ও প্রতিবন্ধিতাজনিত সমস্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জানতে হয়।
পৃথিবীতে কোথাও এখনও কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি, যা দিয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের বুদ্ধি বাড়ানো যেতে পারে। তবে আশ্বস্ত হওয়ার মতো সংবাদ হলো, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের মানসিক ও শারীরিক উন্নতি করা সম্ভব।
বিশেষ শিশুদের যথাযথ বিকাশে তাদের আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে হবে, সমাজের সবার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদানে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে, তাকে একটি বিশেষ কাজে দক্ষ করে তুলতে হবে, কর্মমুখী পেশায় তাকে আগ্রহী করে তুলতে হবে, খেলাধুলা বিনোদনে প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের মাঝে যে বিশেষ দক্ষতা থাকে, তা যথাযথভাবে চর্চার প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এদের মাঝে অনেকেই অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রতিবন্ধী শিশুদের ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে এরা সমাজে অনেক কিছু দিতে পারে।
আসুন আমরা সবাই সরকারের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিই। এতে প্রতিবন্ধী শিশুদের চলার পথ যেমন মসৃণ হবে, তেমনি অভিভাবকদের কষ্টও অনেকাংশে লাঘব হবে। ভুলে গেলে চলবে না ওরা আমাদের শিশু।
পিআইডি ফিচার