জাকারিয়া পলাশ: ছোট-বড় মিলিয়ে ধোলাইখালে প্রায় ৫৫টি মার্কেট রয়েছে। এসব মার্কেটে প্রধানত গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গাড়ি তৈরি না হলেও গাড়ি সার্ভিসিংয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এখন বাংলাদেশ। আর এ খাতের প্রায় সম্পূর্ণ অবদান ধোলাইখালের। বিভিন্ন গাড়ির বাতিল হয়ে যাওয়া যন্ত্রাংশও ঘষে-মেজে নতুন বানাতে সিদ্ধহস্ত সেখানকার কৌশলীরা।
ধোলাইখালে ব্যবসায়ীদের মুখে একটি প্রচলিত কথা আছে। তা হলো ‘যে গাড়ির যন্ত্রাংশ জাপানেও নেই তা পাওয়া যাবে ধোলাইখালে।’ এর কারণ হলো ষাট বা সত্তরের দশকের বিভিন্ন মডেলের গাড়ির যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় ধোলাইখালে, যেগুলো জাপান বা চীনে আর তৈরি হয় না।
শুধু যে গাড়ির যন্ত্রাংশই মেলে ধোলাইখালে তা নয়। পুরোনো গাড়ির যে কোনো যন্ত্রাংশ দেখালে হুবহু তৈরি করে দিতে পারে এখানকার কারিগররা। এজন্য ধোলাইখাল ও আশেপাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক হালকা প্রকৌশল কারখানা। সেখানে পছন্দ অনুযায়ী তৈরি করে নেওয়া যায় যে কোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ। এ ছাড়া তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পের হালকা যন্ত্রাংশও।
তবে অনেকটা অগোছালোভাবেই চলছে দেশের বৃহত্তম এ মটর পার্টসের মার্কেট। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিলে পুরান ঢাকার এ স্থানে সম্ভাবনাময় অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সরেজমিন ধোলাইখাল ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন মার্কেটের পাশাপাশি রাস্তায়, অলিগলিতেও গাড়ির যন্ত্রাংশ ভাঙা ও পুনঃসংস্কার করা হচ্ছে। মেরামত করা হচ্ছে পূর্ণ গাড়িও। রাস্তার ওপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টস নিয়ে বসে আছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী। তারা পুরোনো পার্টস কেনে ও বিক্রি করে। রাবার, ব্রেকসু, গ্লাস হ্যান্ডেল, লুকিংগ্লাস, হর্নসহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নানা যন্ত্রাংশ মেলে সেখানে। কোনোটা দেশি আবার কোনোটা বিদেশি, তবে পুরোনো। স্থানীয়রা অনুমান করেন, সেখানকার ওয়ার্কশপ, লেদ ইন্ডাস্ট্রি এবং পুরোনো যন্ত্রাংশ কেনাবেচা ও পুরোনো গাড়ি কাটার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক ও কারিগর। তবে তাদের সুনির্দিষ্ট ডাটাবেজ তৈরি সম্ভব নয় বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নানজীন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘খাতগুলো অনানুষ্ঠানিক হওয়ায় সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে ধোলাইখালের উদ্যোক্তা ও কর্মীদের যে দক্ষতা রয়েছে তাদের কাজে লাগিয়ে পূর্ণ অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে তোলা সম্ভব। এজন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ধোলাইখালে ব্যবসারত অনেকেরই হয়তো লাইসেন্স আছে। কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণ নেই। আবার অনেকের প্রশিক্ষণ আছে, কিন্তু লাইসেন্স নেই। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সম্মিলিতভাবে একটি টোটাল পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। একইভাবে নওয়াবপুরে যে ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রী তৈরি হচ্ছে তাকেও কাজে লাগানো জরুরি। এজন্য সবার আগে খাত সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন কার্যকর নীতি সহায়তা।’
ধোলাইখালের শ্রমিকরা জানান, গাড়ি সার্ভিসিংয়ের জন্য ছোট-বড় প্রায় চার হাজার রকমের যন্ত্রাংশের প্রয়োজন। এর প্রায় সবই মেলে ধোলাইখালে। বাংলামোটর, বসুন্ধরা, তেজগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মোটর সার্ভিসিং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ যন্ত্রাংশও সরবরাহ করা হয় ধোলাইখাল থেকেই। ধোলাইখালের রাস্তার দুধারে পুরোনো গাড়ি, গাড়ির যন্ত্রপাতি কেনাবেচা হয়। টুটা-ফাটা মোটর পার্টস থেকে শুরু করে বিভিন্ন মডেলের গাড়ি, ট্রাক, ট্রাক্টর, লরি, অটোরিকশা, মেডিক্যাল বেড, ডায়নামোসহ নানা সামগ্রীর খুচরা যন্ত্রপাতি সরবরাহ হয় সেখান থেকে। শুধু যন্ত্রপাতিই নয়, বড় গাড়ি, গাড়ির ইঞ্জিন, লঞ্চের ইঞ্জিনও গড়ে তোলা হয়। এসব কাজের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে সাড়ে ছয় হাজার ছোট-বড় মোটর পার্টসের দোকান।
এ ছাড়া দেশে এখনও জাপানি টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ির গ্রাহক সবচেয়ে বেশি। ওইসব গাড়ির মেরামত ও সার্ভিসিংয়ের জন্য রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রাংশই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কার্যকর। সরেজমিন ধোলাইখালে গিয়ে দেখা গেছে, নতুন-পুরোনো সব যন্ত্রাংশই পাওয়া যায় সেখানে। তবে, মূল আকর্ষণ হচ্ছে রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা।
বিভিন্ন সূত্রমতে, ধোলাইখালে তৈরি হওয়া এসব যন্ত্রাংশের মধ্যে প্রায় ১৩৭টি আইটেম বিশ্বের ১৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। দেশের ৬০ লাখ ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের যন্ত্রাংশ কোনো না কোনোভাবে ধোলাইখাল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব মোটর পার্টস ও হাল্কা প্রকৌশল পণ্যের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে এ খাতটি অসংগঠিত হওয়ায় সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকৌশল শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক ধোলাইখালের বাজার প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শক্তিশালী স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলার জন্য অবকাঠামো ও নীতিগত সহযোগিতা প্রয়োজন। ধোলাইখাল এখন গাড়ির যন্ত্রাংশের খাতে আমদানির বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু এখন এ খাতে বড় উদ্যোগ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সংযোজনও প্রয়োজন।’
মন্তব্য