করপোরেট ট্যাক্সে বৈষম্যের শিকার ৫ খাতের কোম্পানি

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ নিয়াজ মাহমুদ: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েও সমপরিমাণ করপোরেট ট্যাক্স সুবিধা পাচ্ছে না পাঁচ খাতের কোম্পানি। এগুলো হচ্ছে—ব্যাংক, নন-ব্যাংক, বিমা, মোবাইল ফোন ও তামাকজাত দ্রব্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অন্যান্য খাতের কোম্পানি যেখানে ২৫ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স প্রদান করছে, সেখানে উল্লিখিত খাতের কোম্পানিগুলোকে সর্েবাচ্চ ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। যে কারণে এসব খাতের কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে অনাগ্রহী হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত পুঁজিবাজারে মোট ১৯ খাতের কোম্পানি রয়েছে (বন্ড ও ডিবেঞ্চার বাদে)। এর মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, সিরামিক, প্রকৌশল, খাদ্য, আইটি, কাগজ ও প্রকাশনাসহ অন্যান্য খাতের কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সুবাধে ১০ শতাংশ কর রেয়াতে সুবিধা পাচ্ছে। অর্থাৎ এসব কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হচ্ছে ২৫ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এই সুবিধা পেয়ে থাকে। পক্ষান্তরে তালিকাভুক্ত না হলে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট ট্যাক্স প্রদান করতে হয় ৩৫ শতাংশ। কিন্তু এই পাঁচটি খাতের কোম্পানি কর রেয়াতের সুবিধা পাচ্ছে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ। কোনো খাতের কোম্পানি আবার সুবিধাই পাচ্ছে না। তালিকাভুক্ত হয়েও এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে ট্যাক্স প্রদান করতে হচ্ছে অ-তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি।

20170702_014200

এদিকে চলতি অর্থবছরে (২০১৭-১৮) করপোরেট করহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে করহার ২৫ শতাংশ। আর নন-পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এ করহার ৩৫ শতাংশ।

পাবলিকলি ট্রেডেড ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আগের ৪০ শতাংশ। একই প্রতিষ্ঠান নন-পাবলিকলি ট্রেডেড হলে করহার ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকের করপোরেট করহার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। বিড়ি, সিগারেট ও জর্দাসহ সব তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির করহার লিস্টে বা নন-লিস্টে উভয়ের ৪৫ শতাংশ। লিস্টেট মোবাইল ফোন কোম্পানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ ও নন-লিস্টেট কোম্পানির ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ করপোরেট  করহার।

এদিকে তৈরি পোশাক শিল্পে করপোরেট ট্যাক্স গত অর্থবছর ছিল ২০ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছর (২০১৭-১৮) পাঁচ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। লিস্টেট ও নন-লিস্টেট উভয়ের ক্ষেত্রে একই করপোরেট কর।

মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল অপারেটর্স ইন বাংলাদেশ ‘অ্যামটব’ মনে করছে, টেলিযোগাযোগ শিল্পের ওপর নির্ধারিত ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর এই খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য একটি প্রধান অন্তরায়। এটা ভবিষ্যতে ডিজিটাল খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ প্রায় অবশিষ্ট রাখছে না।

এদিকে ট্যাক্স বৈষম্যের কারণ, ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসবে না বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, করপোরেট ট্যাক্স বেশি হওয়ার কারণে বাজারবিমুখ হয়ে আছে রবি, বাংলালিংক, এইচএসবিসি ব্যাংক, ইউনিলিভারসহ বড় বড় অনেক কোম্পানি। অথচ এ ধরনের কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে বাজারে ভালো শেয়ারের জোগান বাড়ত। আর ভালো শেয়ারের জোগান বাড়লে পুঁজিবাজারের চেহারাই বদলে যেতো। এতে কমে আসত দুর্বল কোম্পানির আধিপত্য। কারণ বাজারে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার থাকলে বিনিয়োগকারীরা নামধারী কোম্পানির শেয়ার থেকে দূরে

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স ভিন্ন ভিন্ন। সে কারণে যেসব কোম্পানির ট্যাক্স বেশি, সেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে চায় না। আমি মনে করি, এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনার জন্য করপোরেট ট্যাক্স কমানো উচিত। ট্যাক্স কমানোর সুবাধে যদি ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয় তাহলে সেটা দেশের পুঁজিবাজারের জন্য মঙ্গল।’

একই প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী বলেন, ‘করপোরেট ট্যাক্সের সমন্বয় হওয়া জরুরি। কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে তারা একটু সুবিধা চাইবে, এটা স্বাভাবিক। বাজেটের আগে বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাজেটে এর প্রতিফলন দেখিনি। পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হলে করপোরেট ট্যাক্স সুবিধা আরও বাড়তে হবে।’

জানা গেছে, বর্তমানে ভারতে করপোরেট কর ২৫-৪১ শতাংশ, পাকিস্তান ৩১, সিঙ্গাপুর ১৭, মালয়েশিয়া ২৪ ও ইন্দোনেশিয়ায় ২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন মনে করেন, বিমা কোম্পানির ওপর বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্স ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা জরুরি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতে বিমা খাত বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। কোনো কোনো দেশে জিডিপির ৬০ শতাংশ পর্যন্ত অবদান রাখছে বিমা খাত। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ খাতের অংশগ্রহণ এক শতাংশেরও কম। সরকারের প্রচলিত নিয়ম-কানুন বিমাবন্ধব না হওয়ায় বিমা খাত দেশের জিডিপিতে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ খাতকে গতিশীল করতে করপোরেট করহার কমানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

করপোরেট করের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রস্তাব হলো, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের করপোরেট করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ; তালিকাবহির্ভূত অন্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ (ভ্যাট নিবন্ধনের শর্ত থাকবে); অন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩২ শতাংশ কর আরোপ। এছাড়া যেসব ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত, তাদের করহার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করে আসছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর করহার কমিয়ে ৪০ শতাংশ এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়ে আসছে সংগঠনটি।

 

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০