ফলের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাদামতলীর ব্যবসায়ীরা

পুরান ঢাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে কয়েকটি খাতকে ঘিরে। এসব খাত একদিকে যেমন অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানেও রাখছে ভূমিকা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডভিত্তিক খাতগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের পঞ্চম পর্ব

নাজমুল হুসাইন: দেশি ও আমদানিকৃত উভয় প্রকার ফলই পাওয়া যায় সারা দেশের বিভিন্ন বাজারে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আসে পুরান ঢাকার বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। অন্যদিকে দেশি ফল সারা দেশে বিক্রি হয় বিচ্ছিন্নভাবে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্রি হলেও এর প্রায় ৪০ শতাংশ বাদামতলীর আড়ত ঘুরে খুচরা বাজারে বেচাকেনা হয়। বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাট তিনটি এলাকা মিলেই গড়ে উঠেছে ফল বেচাকেনার এ বিশাল সমাহার, যা ক্রমেই পরিণত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলের বাজার হিসেবে। এখানে প্রতিটি আড়ত ও পাইকারি দোকানেই মৌসুমি ফল আম, জাম, লিচু, আনারস, কাঁঠাল থেকে শুরু করে বিদেশি খেজুর, আপেল, মাল্টা, আনারসহ দেশে উৎপাদিত প্রায় সব ফল পাওয়া যায়।

বাদামতলীর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ বিদেশি ফল এ বাজারে আমদানিকারক ব্যবসায়ীরাই আনেন। এ ছাড়া রাজধানীর কারওয়ান বাজারে হাতেগোনা দু-একজন ও চট্টগ্রামসহ দেশে বিচ্ছিন্নভাবে ডজনখানেক আমদানিকারক ফল আনছেন। এসব ফল চট্টগ্রাম বন্দরসহ সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বুড়িমারী ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আসছে। এসব বন্দরে ফল আমদানি করার সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

ফল বাজারের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, এ পাইকারি বাজারে এখন দুই শতাধিক আড়তদার রয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় চার শতাধিক পাইকার, তিন শতাধিক ফড়িয়া ও শতাধিক খুচরা ব্যবসায়ীও প্রতিদিন ফল বিক্রি করছেন। প্রতিদিন প্রায় গড়ে পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকার ফল এখানে বেচাকেনা হচ্ছে। যার মধ্যে দেশি ফলের বিক্রির পরিমাণ দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার। দেশের যে কোনো ফলের বাজারের তুলনায় যা সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দিনে ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক মৌসুমি ফল বাদামতলীতে আসছে। এতে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। আর আমদানি ও দেশি মিলে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাকে ফল এ বাজারে ওঠানামা করছে।’

তিনি বলেন, ‘সরাসরি বন্দর থেকে, আবার বিভিন্ন হিমাগারে সংরক্ষিত ফল এ বাজারে আসে। আর এ বাজারে প্রায় আড়াইশ আড়তে কয়েক দিনের ফল সংরক্ষণ থাকে। দেশের এটিই এখন সর্ববৃহৎ ফলের বাজার। এখনও প্রচুর আমদানিকারক ব্যবসা করছেন।’

সরেজমিন ফলের এ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিনই পাইকারি ও খুচরা ক্রেতাদের রয়েছে উপচে পড়া ভিড়। সারা দেশের ফল বিক্রেতা এখানে আসেন ফল কিনতে। মৌসুমের শেষের দিকে হলেও এখন বাজারে দেশি বিভিন্ন ফলের প্রচুর সমাহার চলছে। দেশি ফলের প্রাচুর্যের কারণে বিদেশি ফলসহ সব ধরনের ফলের দামে এ বাজার থেকে অন্য যে কোনো বাজারের পার্থক্য অনেক।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছে এসব মৌসুমি ফল। দেশি ফলের আড়ত ওয়াইজঘাট ও সদরঘাটের দিকে বেশি। এসব আড়ত ও দোকানে এখন আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজ, পেয়ারা, পেঁপে, সফেদা, কামরাঙা, আনারস, জামরুল, কাঁচা তাল, লটকন, কলাসহ নানা রকম ফল বিক্রি হচ্ছে। দেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকেই কমবেশি এসব ফল আসে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

পাশাপাশি বিদেশি ফলের মধ্যে আপেল, কমলা, আঙুর, মাল্টা, আনার, নাশপাতি, খেজুর, চেরি, স্ট্রবেরিসহ বিভিন্ন  ফল আসে। মৌসুম ছাড়া এখানে বিদেশি ফলনির্ভরতা বেশি থাকে। পার্শ্ববর্তী ভারত, চীন, ভুটান, সৌদি আরব, দুবাই, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, জর্ডান, ফিলিপাইন, কুয়েত, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বেশি ফল আমদানি হয়।

বাদামতলী ফলের আড়তের সিয়াম ফুড প্রোডাক্টসের স্বত্বাধিকারী কামাল আহমেদ জানান, এখন প্রায় সব মৌসুমি ফলই বাজারে আছে। মৌসুম না হলে বিদেশি ফল বেশি বিক্রি হয়। সারা দেশের বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ হয় এখান থেকে। সারা দেশের বিক্রেতারা ন্যায্য দামেই ফল কিনতে পারেন বলেই এ বাজার অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

এদিকে বাদামতলীর ‘ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি সাধন চন্দ্র বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান বেড়ে চলা এ ফল বাজারের এখন আর স্থান সঙ্কুলন হচ্ছে না। এতে দেশের বৃহত্তম ফল কেনাবেচার পাইকারি আড়ত স্থানান্তর হতে পারে নতুন ঠিকানায়। যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরের বছিলায় এখন আরও বড় পরিসরে এ বাজার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হচ্ছে।’

জানা গেছে, ১৯৩৫ সাল থেকে চলছে বাদামতলী ফলের আড়ত। শুরুতে চার-পাঁচজন ব্যবসায়ীর ফল কেনাবেচা দিয়ে এ বাজারের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এ বাজার বাদামতলী ও ওয়াইজঘাটের আড়তঘর ছাড়িয়ে ফলের বাজার বসে রাস্তা থেকে নদীর তীর পর্যন্ত। ধীরে ধীরে ফল ব্যবসায়ীরা চলে গেছে বুড়িগঙ্গার তীর পর্যন্ত। তৈরি হয়েছে স্থায়ী ছাড়াও শত শত আধাপাকা ঘর। দিনের পর দিন বাদামতলীর ফল আড়ত ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ বাজারে কোনো সাপ্তাহিক বন্ধ নেই।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০