পাটপণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক চূড়ান্ত: শুনানিতে পর্যাপ্ত তথ্য দিতে পারেননি রফতানিকারকরা

জাকারিয়া পলাশ: বাংলাদেশের পাটপণ্যের রফতানির ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক বসাতে যাচ্ছে ভারত। ভারতের স্থানীয় পণ্যের চেয়ে কম দামে বিক্রির (ডাম্পিং) অভিযোগের প্রেক্ষাপটে এ শুল্ক বসানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশি রফতানিকারকদের বিরুদ্ধে ডাম্পিংয়ের অভিযোগ সঠিক নয়। কিন্তু, অনভিজ্ঞতা এবং তথ্য দিতে না পারায় ডাম্পিং সংক্রান্ত অভিযোগ মোকাবিলায় হেরে গেছে বাংলাদেশ। ফলে ভারতে পাটপণ্য রপ্তানি মূল্যের ওপর ‘অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক’ আরোপের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়ে গেছে।

ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং অ্যান্ড অ্যালাইড ডিউটিজ (ডিজিএডি) কর্তৃপক্ষ আগামী জানুয়ারি

থেকে এ শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। ফলে, ভারতের বাজারে বাংলাদেশী

পাট পণ্যের রপ্তানি বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

সূত্র মতে, গত বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ডাম্পিংয়ের অভিযোগ তোলে ভারতের জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন। তারা ডিজিএডি-তে এ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের করে। সাধারণত, বাংলাদেশ থেকে তিন ধরণের পাটপণ্য ভারতে রপ্তানি হয়। এগুলো হলো, হেসিয়ান (চট) ফেব্রিক্স, জুট ইয়ার্ন (সুতা) ও পাটের বস্তা।

নিয়মানুসারে, এ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অ্যান্টি ডাম্পিং এগ্রিমেন্ট (১৯৯৪) অনুসরণ করতে হয়। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী। ওই চুক্তি অসুযায়ী, ডাম্পিংয়ের অভিযোগ তদন্তের জন্য

সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। সে অনুযায়ী, অভিযুক্ত দেশ সত্যিই কমদামে পণ্য পাঠাচ্ছে কিনা তা প্রমাণের পাশাপাশি আমদানিকারক দেশের স্থানীয় শিল্পের উপর এর প্রভাব কী তা স্পষ্ট হতে হয়। তদন্তাধীন সময়ে আমদানীকারক দেশের স্থানীয় শিল্পের ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্তের অপর একটি ধাপ বাকী থাকে। তা হল, কম দামে রপ্তানির সঙ্গে স্থানীয় পণ্যের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিষয়টির সরাসরি সংযোগ প্রমাণিত হতে হবে।

নিয়মানুযায়ী তদন্তের উদ্যোগ নেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। অত্যন্ত জটিল ওই তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে একটি দীর্ঘ প্রশ্নমালা পূরণ করতে হয় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ওই বিষয়ে একটি প্রশ্নমালা বাংলাদেশী জুট স্পিনার্স, জুট মিলস, জুট গুডস এক্সপোর্টার্সসহ ১৩০টি প্রতিষ্ঠানকে পাঠায়। এ সময় বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিকেও ওই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছে। অনেক কোম্পানিকে পাঠানো হয়েছে যারা ভারতে পণ্য রপ্তানি করেই না।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, পৃথিবীর মধ্যে ভারত সবচেয়ে বেশি এন্টি ডাম্পিং শুল্ক বসায়। এ বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ খুবই অভিজ্ঞ ও দক্ষ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদেরকে এ-সংক্রান্ত প্রশ্নপত্র পাঠানো হলেও তারা তার যথাযথ জবাব দিতে পারেনি। সূত্রমতে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে এজন্য কূটনৈতিক পদক্ষেপের অংশ হিসাবে দুই দফায় সময় চেয়ে আবেদন করা হয় বাংলাদেশের তরফে। বাংলাদেশের জন্য পাটখাত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ তার ভারত সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে সরকারী পর্যায়ে কথা বলেন। পরে বাংলাদেশের অনুরোধে, এ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ট্যরিফ কমিশনের কর্মকর্তা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির একটি দল ভারতে যায়। চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল কলকাতায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ সভা হয়।

এ সংক্রান্ত জবাব দেয়ার জন্য নিয়মানুসারে আইনজীবী নিযুক্ত করার কথা থাকলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি বাংলাদেশের পাটরপ্তানিকারকরা। ভারতীয় উৎপাদকরা এ বিষয়ে অভিযোগ করলেও দেশটিতে বড় সংখ্যক আমদানিকারক রয়েছেন যারা বাংলাদেশের পণ্যের উপর শুল্ক বসানোর পক্ষে নন। তারা বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের পক্ষ হয়ে একজন আইনজীবী নিয়োগ দেয়। ওই আইনজীবী বাংলাদেশে এসে পরামর্শক হিসাবে সহায়তা করে।

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) সূত্রে জানা গেছে, যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে তা বড় একটা বইয়ের সমান। কোন দেশে কত পরিমাণ রপ্তানি করা হয়, কী ধরণের পণ্য রপ্তানি করা হয়, উৎপাদন খরচ কত, ডলারের মূল্য কত, স্থানীয় বাজারে বিক্রির পরিমাণ কত এসব তথ্যের ফিরিস্তি চাওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে একজন রপ্তানিকারক শেয়ার বিজকে জানান, ‘অনেক কনফিডেন্সিয়াল বিষয়ও জানতে চাওয়া হয়েছে কিন্তু, এত তথ্য আমরা ভারতকে দেব কেন?’ এদিকে রপ্তানিকারকদের কাছে তথ্য চাওয়া হলেও এ-সংক্রান্ত অভিযোগে ভারতীয় পাটকলের মালিকরা কী বলেছেন তার ‘নন-কনফিডেন্সিয়াল’ অংশ স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে, সব রপ্তানিকারক ওই প্রশ্নপত্রের জবাব দিতে পারেনি। সূত্রমতে, মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠান প্রশ্নপত্রের জবাব দিয়েছিল।

বাংলাদেশের অভিযুক্ত রপ্তানিকারকের দেয়া ওই জবাবের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। তারা যে ২৬টি প্রতিষ্ঠান তথ্য দিয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শণ করে। দুটি পাটকলও পরিদর্শন করা হয়। ওই সফরের সময় তারা বাংলাদেশ জুট গুডস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে দেশের বিভিন্ন রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তখন পর্যবেক্ষক হিসাবে বাংলাদেশ টেরিফ কমিশনের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শন শেষে এ সংক্রান্ত অভিযোগে শুনানি অনুষ্ঠিত হয় দিল্লিতে।

তখনই বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় যে বাংলাদেশের ওপর এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক বসানো হচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ায় সাফল্য না আসায় বাংলাদেশ সরকার দেশীয় রপ্তানিকারকদের পক্ষে কূটনৈতিকভাবে প্রচেষ্টা চালায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুনানি পরবর্তী একটি প্রতিবেদন ভারতের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পেশ করা হয়। ‘পোস্ট-হিয়ারিং সাবমিশন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের সপ্তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশী উৎপাদক ও রপ্তানিকারীদের উপযুক্ত তথ্য সরবরাহের সক্ষমতা ছিল না।

আরও বলা হয়, এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তের প্রক্রিয়া খুবই জটিল এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাট খাতের ব্যবসায়ীরা অনভিজ্ঞ। এছাড়া বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর হাতে মানসম্পন্ন তথ্য নেই। ফলে, ডাম্পিং না করেও ডাম্পিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ব্যবসা হারাচ্ছে বাংলাদেশ।’ এই অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পুনরায় তদন্তের অনুরোধ করা হলেও তা করেনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

গত ২০ অক্টোবর তদন্তের ‘চুড়ান্ত প্রতিবেদনে’ বাংলাদেশের হাসান জুট মিলের দুটি ও জনতা জুট মিলের একটি পণ্য ছাড়া সকল পাটকলের পণ্যের ওপর প্রতি টনে ১৯ ডলার থেকে ৩৫১ ডলার পর্যন্ত শুল্ক বসানোর সুপারিশ করে ভারতীয় ডিজিএডি। তাতে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ার বর্ণানা দিয়ে বলা হয়, ‘প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এর বিরুদ্ধে আপিল চলতে পারে’।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি লুৎফর রহমান শেয়ার বিজকে জানান, ‘আসলে প্রক্রিয়াটা স্পষ্ট নয়। মূলত, ভারতীয় পাটকল মালিকেরা তাদের দেশীয় কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা নিজস্ব উদ্যোগে কিছুই করতে পারবে বলে মনে হয় না। সরকারি তরফেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।’

বিজেএমএ’র মুখপাত্র ও সেক্রেটারি এ. বারিক খান বলেন, ‘বাংলাদেশ বিপুল সংখ্যক পণ্য আমদানি করে ভারত থেকে। এর বিপরীতে পাট পণ্যের উপর শুল্ক প্রত্যাহার করার জন্য রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক উদ্যোগ খুবই জরুরি।’

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সরকারি পক্ষ থেকে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। এখন কূটনৈতিকভাবে অগ্রসর হবে সরকার।’

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০