নিজস্ব প্রতিবেদক: পোশাক শিল্পের রফতানি-আমদানি কার্যক্রমের ৮০ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে। বন্দরে স্বাধীনতার পূর্বে ১৩টি জেটি ছিল। পরবর্তী ৪৬ বছরের মাত্র সাতটি জেটি সংযুক্ত হয়েছে। বন্দরের কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্রেন, হ্যান্ডলারসহ প্রায় এক হাজার ৪৪১টি সরঞ্জামের প্রয়োজন হলেও মাত্র ৪৬১টি সরঞ্জাম রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৬৮ শতাংশ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। ফলে দেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গতকাল সোমবার বিজিএমইএ ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংগঠনটির সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক বাজারের প্রতিযোগিতা ও রেমিডেশনের নানা চাপ মোকাবিলায় আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। পোশাক তৈরির উপকরণ বোঝাই জাহাজকে পণ্য খালাসের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে, পণ্য খালাস করতে না পারায় কন্টেইনার ভাড়া বাবদ বন্দর ও জাহাজ কোম্পানিকে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হচ্ছে। সময়মতো রফতানিপণ্য আমরা পাঠাতে পারছি না, অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে আর্থিক মাশুল দিয়ে উড়োজাহাজেও পণ্য রফতানি করছি। টানা আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে বন্দরে জাহাজজট চলমান থাকার পরিস্থিতির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে জাহাজীকরণ জটিলতা বা রফতানি কন্টেইনার না নিয়েই জাহাজের বন্দর ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা, যা ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বিদেশি ক্রেতারাও সময়মতো পোশাক পাবে না। আর এর মাশুল দিতে হবে রফতানিকারকদের। ক্রেতারা ভারত, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারের মতো দেশে তাদের অর্ডার সরিয়ে নিতে পারেন।’
লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, ‘বন্দরের বর্তমান অবস্থা অনুসারে ২৬টি কি-গ্যান্ট্রি ক্রেন প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র চারটি। এর মধ্যে আবার দুটি বর্তমানে বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। ৫২টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনের চাহিদা থাকলেও রয়েছে ২৩টি। ৩৯টি এম্পটি হ্যান্ডলার প্রয়োজন হলেও আছে ১৯টি। ট্রাক্টর ট্রেইলর রয়েছে ৪৩টি যার প্রয়োজন অন্তত ১৩০টি। এছাড়া কন্টেইনার উঠানো ও নামানোর জন্য যন্ত্রপাতি প্রয়োজন ২৯৯টি, আছে ৮৭টি। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য যন্ত্রপাতি প্রয়োজন ৮৯৫টি, অথচ আছে ২৮৫টি।’
বেনাপোল স্থলবন্দর সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। হরিদাসপুর থেকে পোশাক শিল্পের আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোলে পৌঁছতে স্বাভাবিকভাবে দুদিন লাগলেও কখনও কখনও ১০ দিনও লেগে যাচ্ছে।’ এ সমস্যা সমাধানের জন্য ঢাকা-কলকাতা ট্রেন কার্গো চালু করার প্রস্তাব করে সংগঠনটি।
নৌ ও স্থলবন্দরের নানা সমস্যার কথা উল্লেখ করে বিজিএমইএ’র সভাপতি বলেন, ‘বন্দরে বিকল হওয়া দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন দ্রুত মেরামত করা, কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি জরুরিভিত্তিতে সরকারিভাবে অথবা বেসরকারি খাত থেকে ভাড়া নিয়ে বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে হবে।’ এছাড়া বন্দরের চলমান প্রবৃদ্ধিকে সামনে রেখে সক্ষমতা বাড়াতে ২৬ একর পশ্চাৎ সুবিধাদিসহ পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণকাজ শুরু, বন্দর জেটির ৭নং খালের পাশে সাড়ে ১৬ একর জায়গায় সাউথ কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করে তা চালু করাসহ বেশ কিছু সংস্কার কাজ করার দাবি জানান তিনি।
তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের এ সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাণিজ্যমন্ত্রী রফতানির জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু বন্দরের সক্ষমতা না বাড়ালে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। বর্তমান অবস্থায় আমাদের চট্টগ্রাম থেকে পণ্য ফিডার ভেসেলে করে পাঠাতে হয়। সেগুলো সিঙ্গাপুরে গিয়ে আবার মাদার ভেসেলে দিতে হয়। এতে করে বাংলাদেশ থেকে পণ্য গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগে ৩৭ দিন। একই প্রক্রিয়া শেষ করতে আমাদের প্রতিযোগী দেশ সিঙ্গাপুর, ভারতের লাগে মাত্রা ১৭ দিন। এ কারণে অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই আমাদের এখানে ব্যবসা করতে চাচ্ছে না। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য অনুসারে শুধু লিড টাইমের এ ব্যবধানের কারণে অন্তত এক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হারিয়েছি আমরা। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার বেশি মূল্যায়ন ও বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে রফতানিকারকরা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে দুই বছরের জন্য পাঁচ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া জরুরি।
এছাড়া পোশাক খাতের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান, সহ-সভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাছির, সহ-সভাপতি ফেরদৌস পারভেজ বিভন, পরিচালক মো. মনির হোসেন ও পরিচালক আনোয়ার কামাল পাশা উপস্থিত ছিলেন।
Add Comment