নাজমুল হুসাইন: অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমায় দেশে সৃষ্টি হয়েছে চালের সংকট। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন চাল আমদানিই একমাত্র ভরসা। কিন্তু চাল আমদানি শুরুর পর থেকেই স্বস্তি মেলেনি সরকারের। প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈশ্বিক চালের বাজারে প্রতিযোগিতা। বর্তমানে বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক চালের বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে। আগামী বছর চীন ও ইরানের বৃহৎ আমদানির প্রভাবে আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন এগ্রিকালচার সার্ভিসের (ইউএসডিএ) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর (২০১৭-১৮) অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমায় বাংলাদেশকে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে। কিন্তু এ বছর একই সঙ্গে চীন ও ইরান কয়েকগুণ চাল আমদানি করবে, যা রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতায় কারণে মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট তৈরি করবে।
প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী বছর প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে চীন ৫৩ লাখ টন চাল আমদানি করবে, যেখানে দেশটির আগের বছর মাত্র আড়াই লাখ টন চাল আমদানি করার প্রয়োজন হয়েছিল। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ইরান কিনবে ১৩ লাখ টন চাল, যা আগের বছর ছিল মাত্র দুই লাখ টন।
আবার যুক্তরাষ্ট্র গত বছর ৩৫ লাখ টন চাল রফতানি করলেও চলতি বছর তা মাত্র এক লাখ টনে নামবে। এছাড়া পাকিস্তানের চাল রফতানি ৩৯ লাখ টন থেকে এক লাখে নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে ইউএসডিএ বলছে, গত অর্থবছর তিন কোটি ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হলেও চলতি বছর তা কমে তিন কোটি ৩৫ লাখ টনে নামবে। এতে আমদানি তিন লাখ টন থেকে বেড়ে ১০ লাখ টন হবে।
প্রসঙ্গত, এ বছর হাওরে ফসলহানি ও উত্তরাঞ্চলে বন্যায় দেশে চালের উৎপাদন কমেছে। ফলে চাল আমদানি শুরু করেছে বাংলাদেশ। অপরদিকে নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে চাল আমদানি করতে হচ্ছে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কাকেও। ফলে এখন বাংলাদেশ, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতা বৈশ্বিক চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সরবরাহ কমায় বর্তমানে চাল রফতানিকারক দেশগুলো দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রচুর চাল রফতানি করলেও সেই সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক বছরে ভারতীয় চালের মূল্য ৩৭ ডলার বেড়েছে। গত বছরের এই সময় ভারত প্রতি টন সিদ্ধচাল ৩৬৭ ডলারে বিক্রি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ চাল আমদানি শুরু করার পর থেকেই টনপ্রতি ভারতীয় চালের এফওবি দাম ৪১৫ ডলারে পৌঁছে যায়। এর পর থেকে প্রতি মাসেই ভারতীয় চালের দাম বাড়ছে।
এদিকে ফরেন এগ্রিকালচার সার্ভিসের পূর্বাভাসে অনুযায়ী আগামী বছর চালের শীর্ষ রফতানিকারক দেশ হবে ভারত। ওই বছর ভারত থেকে এক কোটি ১৮ লাখ টন চাল রফতানির পূর্বাভাস করা হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে মিয়ানমারও আগামী বছর ২০ লাখ টন চাল রফতানি করবে।
কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে চাল আমদানি কখনোই সুবিধাজনক হয়নি। বাংলাদেশে যখনই চাল নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে তখনই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ভারত। এমনকি এর আগে চাল আনার চুক্তি করেও ভারত থেকে চাল আনতে পারেনি সরকার। গত মঙ্গলবার এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রীও। সচিবালয়ে এক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যখন খাদ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখন ভারত থেকে চাল আমদানি করতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মাত্র পাঁচ লাখ টন চাল আনার চুক্তি করেও কোনো চাল আনতে পারিনি।’ পরে ভিয়েতনাম থেকে চাল এনে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন বলে জানান রাজ্জাক।
অন্যদিকে চেষ্টা চালিয়েও আরেক রফতানিকারক দেশ মিয়ানমারের কাছ থেকে চাল আমদানিতে তেমন সুবিধা করতে পারছে না বাংলাদেশ সরকার। দেশে চালের সংকট শুরুর পরেই কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড সরকারের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে জি-টু-জি পদ্ধতিতে চাল আমদানির চুক্তি করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তখন মিয়ানমারের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চুক্তি করতে চাইলে তা ব্যর্থ হয়। সে সময় প্রতি বছর ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির প্রস্তাব নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল মিয়ানমার সফর করে, কিন্তু মিয়ানমার সরকার ওই সময়ে চুক্তি করেনি।
তখন দেশটির প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশ সফরে এসে প্রতিনিধিদলটি আলোচনা করেই চুক্তি করবে। আর সে মোতাবেক চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা। এরপর নানা দর কষাকষির পরে মাত্র এক লাখ টন আতপ চাল আমদানির চুক্তি সই হয়। আতপের বদলে সিদ্ধচাল চেয়েও পায়নি বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম ড. আসাদুজ্জামান বলেন, চীনের প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানির প্রয়োজন হলে তা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করবে এটা ঠিক, কিন্তু আগামী কয়েকটি মৌসুমে ফসলের উৎপাদন ভালো হলে চালের সংকট কাটিয়েও উঠতে পারে বাংলাদেশ। ফলে এতে চরম উদ্বেগের কিছু দেখছি না।
তিনি বলেন, সবার আগে সরকারকে তাদের স্বাভাবিক মজুদ নিশ্চিত করতে হবে। আর ভারত থেকে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে চালের আমদানির চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে সব অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিপক্ষে থাকা উচিত বাংলাদেশের।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতির তথ্য অনুসারে, বর্তমানে সরকারের মজুদ চাল তিন লাখ ৫৬ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে (২০১৭-১৮) এ পর্যন্ত সরকারি খাতে দুই লাখ ১০ লাখ টন চাল এবং বেসরকারি খাতে পাঁচ লাখ ৮৯ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে।