ঝুঁকির মুখে অর্থনীতির সব খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডলারের বিপরীতে টাকার মান হঠাৎ আরও কমেছে। একদিনে ডলারের দাম বেড়েছে ৭ টাকা। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এর আগে দেশে ডলারের দাম কখনও একসঙ্গে এতটা বাড়েনি। তাই ডলারের দর বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়তে যাচ্ছে অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই। চাপ তৈরি হবে বিদেশি ঋণ পরিশোধ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের ওপর। বাড়বে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝাও। এলসি সমন্বয় ব্যয়ও বেড়ে যাবে। এতে আমদানিকৃত সব পণ্যের দাম বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরেক দফা বৃদ্ধি পাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি টাকা ডলার ঋণের প্রাপ্তির শর্ত মেনে অনেকটা তড়িঘড়ি করে গত বুধবার ডলারের নতুন দর নির্ধারণ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সময়ে এসে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি অনুসরণের ঘোষণা দিল, যখন দাতা সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর শেষ করতে যাচ্ছে। প্রতিশ্রুত ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে পর্যালোচনা করতে গত ২৪ এপ্রিল আইএমএফের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। প্রতিনিধিদলটির দীর্ঘ সফর ৮ মে বুধবার শেষ হয়েছে।

এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের কারণে আমদানির পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, ডলারের দর বাড়ার কারণে শুল্ক বৃদ্ধিসহ সব আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে যেতে পারে। এছাড়া ৭ টাকা বাড়ার কারণে আমদানি ব্যয় (কস্টিং) অনেক বাড়বে, আমদানিতে বড় লোকসান হবে। এছাড়া বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ অনেক বেড়ে যাবে।

সূত্রমতে, ডলারের দর আনুষ্ঠানিকভাবে এক লাফে ৭ টাকায় বৃদ্ধিতে বিদেশি ঋণ পরিশোধে বাড়তি খরচ বহন করতে হবে। এতে সরকারের বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন (১০ হাজার ৬৪ কোটি) ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে) ছিল ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। তবে গত বুধবার ডলারপ্রতি ৭ টাকা বেড়ে যাওয়ায় ঋণের পরিমাণ দেশীয় মুদ্রায় এক লাফে বেড়েছে ৭০ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। কারণ বুধবার থেকে ডলারের বিনিময় হার ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে হিসেবে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা।

এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছর সরকারের ঋণ ও সুদ পরিশোধ ব্যয় এমনিতেই বেড়ে গেছে। গত মার্চ পর্যন্ত ঋণের আসল পরিশোধ করা হয়েছে ১৫১ দশমিক ৬৬৪ কোটি ডলার ও সুদ পরিশোধ করা হয় ১০৫ দশমিক ৪৫১ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৬ হাজার ৬৭৯ কোটি ৬২ লাখ ও ১১ হাজার ৬০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। সুদ ও আসল মিলিয়ে মোট পরিশোধ করা হয়েছে ২৫৭ দশমিক ১৫৫ কোটি ডলার বা ২৮ হাজার ২৮১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর প্রতি মাসে গড়ে বিদেশি ঋণ (সুদ ও আসল) পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ কোটি ৫৭ লাখ ডলার বা তিন হাজার ১৪২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। একই হারে পরিশোধ করলেও মাসে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ ব্যয় দাঁড়াবে তিন হাজার ৩৪২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদেশি ঋণ পরিশোধ একই হারে থাকলেও দেশীয় মুদ্রায় এ খাতে ব্যয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা বেড়ে যাবে।

এদিকে ডলারের দর বৃৃদ্ধিতে পূর্বের খোলা এলসি নিষ্পত্তিতেও প্রভাব পড়বে। কারণ এখন ৭-৮ টাকা বাড়তি দরে এলসি নিষ্পত্তি করতে হবে। এতে বিপাকে পড়বেন আমদানিকারকরা। কারণ আমদানি প্রক্রিয়াধীন পণ্যের জন্য তাদের ব্যয় এক লাফে ছয় শতাংশের বেশি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি নতুন এলসি খোলার দরও ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। গত বুধবার ১১৫ টাকায় এলসি করছিল এরকম ব্যাংক গতকাল বৃহস্পতিবার ১১৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১৮ টাকা দর নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে জ্বালানি তেল বিশেষত ডিজেলের দাম বাড়বে। সার আমদানি ব্যয়ও বাড়বে। কারণ ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত দরে ডলার কিনলেও সার ও জ্বালানির মতো পণ্য আমদানিতে এতদিন ১১০ টাকা দামে ডলার দিত বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন তা ১১৭ টাকায় বিক্রি করা হবে। পাশাপাশি এলপিজির দামও বাড়বে। কারণ ডিজেল ও এলপিজিÑএ দুটো পণ্যের দর প্রতি মাসে সমন্বয় করা হয়। এজন্য নির্ধারিত সূত্রে ডলারের বিনিময় হার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আর ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহন ভাড়াও বেড়ে যাবে।

বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, ডলার দর বৃদ্ধির ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ পড়বে। কারণ এ ৭ টাকা সরকারকে বাড়তি পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া জ্বালানি ও সার আমদানির জন্য ১১০ টাকা দামে ডলার বিক্রি করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের দাম বাড়ানোর কারণে এসব পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। এখন সরকারের এসব সামাল দিতে সক্ষমতা তথা রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।

অন্যদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ খাতের ওপর। কারণ এ খাতে বিশেষত ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার ধরা হয় সোনালী ব্যাংকের ডলারের বিনিময় হার অনুযায়ী। অর্থাৎ ১১০ টাকা দরে ডলারের দর ধরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়। তবে এখন তা ১১৭ টাকা ধরে পরিশোধ করতে হবে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমদানিকৃত জ্বালানি তেল ও কয়লার দামও সরাসরি ডলারে পরিশোধ করা হয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গত বছর এক হিসাবে দেখায়, ডলারের বিনিময় হার এক টাকা বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বাড়ে ৪৭৪ কোটি টাকা। ফলে সাত টাকা দর বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে গেছে ৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা।

যদিও প্রকৃতপক্ষে এ ব্যয় আরও বেশি বাড়বে বলে মনে করছেন পিডিবির কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, গত বছর এ হিসাব দেখানোর পর নতুন আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। নতুন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এছাড়া ভারতের আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয় গত বছরের এপ্রিলে। এ আমদানি ব্যয় ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এতে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ডলারের দর বাড়ানোর কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং জ্বালানি তেল ও সার আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। তবে ডলারের দর অনেক বেশি আটকানো ছিল। তাই এটাকে স্থিতিশীল করতে হবে। এজন্য সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। সুদের হার উš§ুক্ত করায় যদি সফলতা আসে ও ডলার যদি ১১৭ টাকায় থাকে তাহলে এটা সরকার এবং সাধারণ জনগণের জন্য ভালো হবে।

এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে খাদ্য বিশেষত আমদানিকৃত খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। কারণ একদিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহন ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি ব্যয় বাড়লে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়বে। এছাড়া আইএমএফের শর্তের কারণে এরই মধ্যে বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর সার্বিক প্রভাব পড়বে অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপে আছে। এখন হঠাৎ করেই ডলারের দাম খুব বেশি বাড়ানোয় নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হবে; বিশেষ করে আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে অনেক; এতে পণ্যের দামও বাড়াতে বাধ্য হবেন আমদানিকারকরা।’

তিনি বলেন, হঠাৎ করেই ডলারের বেশি দাম বাড়ার এমন সিদ্ধান্তে চাপে পড়বেন সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে, মানুষ কষ্ট পাবে। এক্ষেত্রে ধীরে ধীরে দাম বাড়ালে হয়তো কষ্ট কিছুটা কম হতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে সব দিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া।

জুয়া হুন্ডির কারণে মুদ্রা পাচার বাড়ছে: অর্থমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক: জুয়া ও হুন্ডির কারণে মুদ্রা পাচার বাড়ছে এবং এর ফলে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে গতকাল চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আব্দুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। অর্থমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সময়ে দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ও ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে লেনদেনের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তিগত এ উন্নয়নের সুবিধা কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু চক্র অনলাইন জুয়া-বেটিং, গেমিং, ফরেক্স, ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং ও হুন্ডি প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, এর ফলে একদিকে যেমন দেশ থেকে মুদ্রা পাচার বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, অনলাইন জুয়া-বেটিং ও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধসহ সব ধরনের অর্থ পাচার রোধকল্পে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ) ও সংশ্লিষ্ট অন্য আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। অনলাইন জুয়া-বেটিং এবং হুন্ডির সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে এ পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৫৮৬টি ব্যক্তিগত এমএফএস হিসাব বিএফআইইউ কর্তৃক স্থগিত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত অভিযোগে পাঁচ হাজার ৭৬৬ জন এজেন্টের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে তাদের তথ্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে হুন্ডি লেনদেনে জড়িত সন্দেহে পাঁচ হাজার ২৯টি এমএফএস এজেন্টশিপ এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে। হুন্ডির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে ২১টি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ৩৯টি হিসাবের তথ্যাদি সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। অবৈধ হুন্ডি, গেমিং, বেটিং, ক্রিপ্টোকারেন্সির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এমএফএস প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিএফআইইউয়ের নির্দেশনা মোতাবেক এ পর্যস্ত ১০ হাজার ৬৬৬টি এমএফএস এজেন্ট হিসাবের লেনদেন ব্লক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০