মাসুম বিল্লাহ: গত বছরের জুনে নিম্নস্তরের সিগারেটে বিদেশি ও দেশি কোম্পানির জন্য পৃথক মূল্যস্তর নির্ধারণ করা হয়, কিন্তু সে নির্দেশনা মান্য করেনি বিদেশি সিগারেট কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। এ নির্দেশনা অমান্য করার ফলে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ মাসে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছিল এক হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। মে মাস পর্যন্ত হিসাব করলে তা দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। গত ৭ মার্চ আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে দেশি-বিদেশি সব সিগারেটের দাম একই নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে ওই রাজস্ব পরিশোধ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে বিএটিবিসি।
নি¤œস্তরে বর্তমানে বিএটিবিসির তিনটি ব্র্যান্ডের সিগারেট রয়েছে। এগুলো হলোÑডারবি, হলিউড ও পাইলট। গত বছরের ১ জুন ঘোষিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে কোম্পানিটিকে প্রতি ১০ শলাকা নি¤œস্তরের সিগারেট ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর একই স্তরের দেশি সিগারেট প্রতি ১০ শলাকা ২৭ টাকায় বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়। নি¤œস্তরের সিগারেট প্রস্তুতকারী দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আকিজ গ্রুপের ঢাকা টোব্যাকো, আবুল খায়ের গ্রুপ ও নাসির গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
গতবছর বাজেটে দেওয়া নির্দেশনা উপেক্ষা করে বছরব্যাপী দেশি কোম্পানির জন্য নির্ধারিত দামে নি¤œস্তরের সিগারেট বিক্রি করে বিএটিবি। এতে সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে, তার একটি চিত্র প্রতি মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠাত বিএটি থেকে রাজস্ব সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান এলটিইউ (ভ্যাট)। সর্বশেষ গত এপ্রিলে একটি চিঠি পাঠায় এলটিইউ। এতে উল্লেখ করা হয়, নি¤œস্তরের দেশি ও বিদেশি কোম্পানির সিগারেটে দামের পার্থক্যের কারণে ২০১৭ সালের ১ জুন বাজেট ঘোষণার দিন থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯ মাসে বিএটিবির কাছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ প্রায় এক হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে সরকার বা এনবিআরের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দাবিনামা জারি করতে পারেনি এলটিইউ। জানা যায়, অর্থমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় বছরজুড়েই বিএটির বিপক্ষে মূল্যস্তরের পার্থক্যের বিষয়ে কোনো দাবিনামা জারি করেনি এলটিইউ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভ্যাট এলটিইউয়ের কমিশনার মো. মতিউর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছি। গতবছর যে আদেশ জারি করা হয়েছিল, এবারের আদেশের ফলে তা স্থগিত হয়ে গেছে। ফলে মূল্যস্তরের পার্থক্যের কারণে এখন বিএটিবি থেকে রাজস্ব আহরণের সুযোগ নেই।
বিদেশি কোম্পানি হিসেবে বিএটিবির প্রতি যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা মানছে না কোম্পানিটি। ফলে প্রতি মাসেই প্রায় ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে সিগারেটের বাজার প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে নিম্নস্তরের সিগারেটের দখলে রয়েছে মোট বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে নিম্নস্তরের সিগারেটের বাজার প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল বিএটিবিসির দখলে আছে নিম্নস্তরের বাজারের ৬৩ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ১১ কোটি টাকার নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি করে। প্রতি প্যাকেটে ১০ শলাকা করে থাকলে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটি নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি করে সাড়ে ৪২ কোটি প্যাকেট। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্নস্তরে দেশি ও বিদেশি উভয় শ্রেণির সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানির জন্য একই হারে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে প্রতি ১০ শলাকা নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ধরা হয়েছে ৩২ টাকা। তবে চূড়ান্তভাবে এটি ৩৫ টাকা হতে পারে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিম্নস্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক ধার্য আছে ৫৫ শতাংশ। এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আছে আরও ১৫ শতাংশ হারে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএটিবির প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেট ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করার কথা, কিন্তু সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে প্রতি ১০ শলাকা ২৭ টাকা দরে বিক্রি করে রাজস্ব জমা দিচ্ছে বিএটিবিসি। সে হিসাবে প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে নিম্নস্তরের জন্য সরকার সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা পায়। ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করলে সরকার প্রতি ১০ শলাকায় আরও পাঁচ টাকা ৬০ পয়সা হারে বেশি রাজস্ব পেত। সে হিসাবে সাড়ে ৪২ কোটি প্যাকেটে প্রতি মাসে আরও ২০০ কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব পেত সরকার।
এদিকে সিগারেট কোম্পানিকে এভাবে ছাড় দেওয়া প্রত্যাশিত নয় বলে জানিয়েছেন দ্য ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম। শেয়ার বিজকে তিনি বলেন, ‘তামাক জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক হুমকি বয়ে আনছে। এভাবে বিশেষ কোনো কোম্পানিকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে তামাকের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। অন্যদিকে সিগারেট ও তামাক খাতে কর নির্ধারণের জন্য সময়োপযোগী রূপরেখা তৈরি করতে হবে। সেটি না করে একেক বছর একেকভাবে কর নির্ধারণ করা হলে তাতে কোম্পানিগুলোর ফাঁকি দেওয়ার পথই প্রশস্ত হবে। তামাকপণ্যের ব্যবহার কমাতে হলে ওই খাতের ওপর নির্ভরতাও কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য সঠিক পরিকল্পনা দরকার।’