মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ: গ্যাসের বিতরণ মার্জিন বাড়ানোর জন্য গ্যাস কোম্পানিগুলোর করা প্রস্তাবের পক্ষে নয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি। প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে গ্যাস বিতরণকারী সাত কোম্পানির মধ্যে পাঁচটির বিতরণ মার্জিন কমানোর সুপারিশ করেছে এ কমিটি। আর দুটি কোম্পানির বিতরণ চার্জ সামান্য বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
বিভিন্ন কোম্পানির গ্যাসের মূল্য ও বিতরণ চার্জ বৃদ্ধির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পক্ষের অংশগ্রহণে গত ১১ জুন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত রাজধানীর টিসিবি ভবনে গণশুনানি করে বিইআরসি। এতে অংশ নিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে আর বিইআরসির কারিগরি কমিটি প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে তাদের সুপারিশ দেয়।
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সঞ্চালন চার্জ ইউনিটপ্রতি ২৬ দশমিক ৫৪ পয়সা থেকে ১৮ দশমিক ২২ পয়সা বৃদ্ধি করে ৪৪ দশমিক ৭৬ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। বলা হয়, কোম্পানির নতুন সম্পদ সংযোজন ও অবচয় বৃদ্ধির কারণে খরচ বাড়বে। কিন্তু প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে কারিগরি কমিটি বলেছে, জিটিসিএলের রেট বেজের ওপর রিটার্ন বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নিট রাজস্ব চাহিদা ইউনিটপ্রতি ৩৬ দশমিক ৮১ পয়সা আর বিদ্যমান ট্রান্সমিশন চার্জ ২৬ দশমিক ৫৪ পয়সা, সে হিসেবে বিদ্যমান ট্যারিফ ঘাটতি ১০ দশমিক ২৭ পয়সা। তাই বিদ্যমান ঘাটতি সংকুলানে ট্রান্সমিশন চার্জ সমন্বয় করা প্রয়োজন। বলা হয়, নতুন সম্পদ সংযোজনের কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিটার্ন অন রেট বেজ এবং অবচয় ব্যয় বৃদ্ধি ইউনিটপ্রতি মোট ১০ পয়সা।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড তাদের বিতরণ চার্জ ঘনমিটারপ্রতি ২৩ দশমিক ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪৯ দশমিক ৮৭ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়, শতাংশের হিসাবে যা ১১৫ শতাংশ। যদিও বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তিতাসের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে ঘনমিটারপ্রতি বিতরণ চার্জ মাত্র তিন দশমিক ৭০ পয়সা বাড়িয়ে ২৬ দশমিক ৮৬ পয়সা করার সুপারিশ করেছে।
কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, তিতাস গ্যাসের রেট বেজের ওপর রিটার্ন বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট রাজস্ব চাহিদা ইউনিটপ্রতি ২৬ দশমিক ৮৬ পয়সা।
এদিকে বিতরণ চার্জ বাড়ানোর জন্য কর্ণফুলী, পশ্চিমাঞ্চল, বাখরাবাদ, সুন্দরবন ও জালালাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রস্তাবের বিপরীতে উল্টো তা কমানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) তাদের বিতরণ চার্জ ৩২০ শতাংশ বাড়িয়ে ঘনমিটারপ্রতি ২৫ পয়সা থেকে এক টাকা পাঁচ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। যদিও কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি কর্ণফুলীর প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে গ্যাসের বিতরণ চার্জ বাড়ানোর বিপরীতে ঘনমিটারপ্রতি পাঁচ পয়সা কমিয়ে বর্তমান ২৪ দশমিক ৮৯ পয়সার বদলে ১৯ দশমিক ৮৮ পয়সা করার সুপারিশ করে। কারিগরি মূল্যায়র কমিটি বলেছে, কর্ণফুলী গ্যাসের রেট বেজের ওপর রিটার্ন বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট রাজস্ব চাহিদা ইউনিটপ্রতি ১৯ দশমিক ৮৮ পয়সা ও বিদ্যমান বিতরণ চার্জ ২৪ দশমিক ৮৯ পয়সা।
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি তাদের বিতরণ চার্জ ৪০ দশমিক শূন্য চার পয়সা থেকে ২৬ দশমিক ৫৪ পয়সা বাড়িয়ে ৬৬ দশমিক ৫০ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। তবে কমিশনের কারিগরি কমিটি তা দশমিক শূন্য তিন পয়সা কমিয়ে ২৬ দশমিক ৫১ পয়সা করার সুপারিশ করে। সুপারিশে বলা হয়, গ্যাস বিতরণ ট্যারিফ নির্ধারণ পদ্ধতি মোতাবেক পশ্চিমাঞ্চল গ্যাসের রেট বেজের ওপর রিটার্ন বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রাক্কলিত পশ্চিমাঞ্চল গ্যাসের নিট রাজস্ব ঘাটতি দশমিক শূন্য তিন পয়সা।
বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির প্রস্তাবে দেখা যায়, এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান বিতরণ চার্জ ২৫ দশমিক ৩০ পয়সা থেকে ২৫ দশমিক ৮১ পয়সা বাড়িয়ে ৫১ দশমিক ১১ পয়সা চায়। তবে কমিশনের কারিগরি কমিটি তাদের সুপারিশে বলে, রেট বেজের ওপর রিটার্ন বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রাক্কলিত বাখরাবাদ গ্যাসের নিট রাজস্ব চাহিদা ঘনমিটারপ্রতি ১৮ দশমিক ৫৬ পয়সা। আর বিদ্যমান বিতরণ চার্জ ২৫ দশমিক ৮১ পয়সা।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি বর্তমান বিতরণ চার্জ ঘনমিটারপ্রতি এক টাকা ১৯ পয়সা বাড়িয়ে ২৯ দশমিক ৫৩ পয়সা থেকে এক টাকা ৪৮ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। তবে কমিশনের কারিগরি কমিটি বাড়ানোর বদলে বিতরণ চার্জ ঘনমিটারপ্রতি ১৩ দশমিক ২৮ পয়সা কমানোর সুপারিশ করে। সুপারিশে বলা হয়, সুন্দরবন গ্যাসের রেট বেজের ওপর রিটার্ন এবং জাতীয় গ্যাস গ্রিড থেকে জিটিসিএলের সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে ৭৫৩ দশমিক ৮৭ এমএমসিএম গ্যাস ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবনের বিতরণ সিস্টেমে সরবরাহ বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট রাজস্ব চাহিদা ঘনমিটারপ্রতি ১৬ দশমিক ২৫ পয়সা।
জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি তাদের বর্তমান বিতরণ চার্জ ঘনমিটারপ্রতি সাত দশমিক ২৪ পয়সা বাড়িয়ে ৩১ দশমিক ১৫ পয়সা থেকে ৩৮ দশমিক ৩৯ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। তবে মূল্যায়ন কমিটি তা কমানোর সুপারিশ করে। সুপারিশে বলা হয়, রেট বেজের ওপর রিটার্ন বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রাক্কলিত জালালাবাদ গ্যাসের নিট রাজস্ব চাহিদা ঘনমিটারপ্রতি ১০ দশমিক ৩৫ পয়সা। আর বিদ্যমান বিতরণ চার্জ ২৫ পয়সা।
কারিগরি কমিটি তাদের সুপারিশে আরও বলেছে, ইভিসি মিটার স্থাপনের মাধ্যমে প্রকৃত গ্যাস সরবরাহ চাপ অনুযায়ী গ্রাহকের প্রকৃত ব্যবহারভিত্তিক বিল প্রণয়ন নিশ্চিত করা আবশ্যক। মিটারবিহীন গৃহস্থালি গ্রাহকের প্রকৃত গ্যাস ব্যবহার নিরূপণের লক্ষ্যে কমিশন কর্তৃক একটি জরিপ আবশ্যক। বলা হয়, গ্যাস বিক্রির পরিমাণে কোনো ধরনের সমন্বয় করা যাবে না। প্রকৃত মিটার রিডিং বা গ্যাস মোতাবেক গ্যাস বিক্রির পরিমাণ নিরূপণ করতে হবে এবং সিস্টেম লস হিসাব করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিই কোম্পানিগুলোর বিতরণ চার্জ বাড়ানোর পক্ষে নয়, বরং কমানোর সুপারিশও করা হয়েছে। কাজেই বিতরণ চার্জ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাই কমিশনের কাছে আহ্বান থাকবে যেন বিতরণ চার্জ না বাড়ানো হয়।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, গ্যাস খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। গ্যাস চুরি ও অনিয়ম বন্ধ করা গেলে গ্যাসের মূল্য ও বিতরণ চার্জ বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।
গ্যাস কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের পক্ষে নয় কারিগরি কমিটি
