অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে মাশরুম। এর পুষ্টিগুণসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হলো
মাশরুম একটি পুষ্টিকর সবজি। কিন্তু সবজির মতো এটি মাটিতে জন্মায় না। এটি মূলত নিন্মশ্রেণির ছত্রাক-জাতীয় পরজীবী উদ্ভিদ। দেখতে ব্যাঙের ছাতার মতো। জীবন ধারণের জন্য এরা জৈবিক বস্তু থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি আহরণ করে। দেখতে ব্যাঙের ছাতার মতো হলেও দুয়ের মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্ম নেওয়া মাশরুম বিষাক্ত হয়, সেগুলো খাওয়া যায় না।
বর্তমানে মাশরুম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হয়। এ পদ্ধতিতে চাষ করা মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিকর। অনেক দেশে সবজি হিসেবে এটি জনপ্রিয়। আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাশরুম চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে।
চাষ পদ্ধতি
মাশরুম খোলা জায়গায় চাষ করা যায় না। তাই আবাদি জমির প্রয়োজন নেই। মাশরুম চাষের জন্য ছায়াযুক্ত জায়গায় ছন বা বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করতে হয়। মাটির দেয়াল দিয়েও ঘর তৈরি করা যায়। আবার বাঁশের বেড়াও দেওয়া যায়। ঘরের ভেতর যেন আলো ঢুকতে না পারে, সেজন্য বাঁশের বেড়ায় মাটি লেপে দিতে হয়।
দুইভাবে চাষ করা যায়
পদ্ধতি ১
মাশরুমের এক কেজি অথবা আধা কেজি ওজনের একটি বীজ পলিথিনের প্যাকেটে সংগ্রহ করতে হবে
সংগৃহীত বীজ প্যাকেটের দুই পাশে অর্ধবৃত্তাকার করে কেটে চেঁছে দিন
এরপর পানিতে ৩০ মিনিট পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখুন। পানি থেকে উঠিয়ে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট উপুড় করে অতিরিক্ত পানি ঝরিয়ে নিন। এবার ঘরের নির্ধারিত জায়গায় রেখে দিন
প্রতিদিন তিন থেকে চারবার করে পানি ছিটিয়ে দিন
তিন থেকে চার দিন পর কাটা জায়গা থেকে অঙ্কুর গজাবে
অঙ্কুর গজানোর পর মাঝেমধ্যে পানি ছিটিয়ে দিন
পাঁচ থেকে ছয় দিন পর খাওয়ার উপযোগী মাশরুম পাওয়া যাবে
খাবার উপযোগী মাশরুম গোড়া থেকে তুলে নিন
বীজের কাটা জায়গাটা একটু চেঁছে দিন। এই বীজ থেকে আবার মাশরুম গজাবে।
পদ্ধতি ২
মাশরুমের এক কেজি ওজনের একটি বীজ পলিথিন প্যাকেট সংগ্রহ করতে হবে
বীজের প্যাকেটের মুখ খুলে ভেতরে কম্পোস্ট গুঁড়ো দিতে হবে
দুই কেজি পরিমাণ ধানের পরিষ্কার ও শুকনো খড় সংগ্রহ করুন খড়গুলোকে এক ইঞ্চি মাপে কেটে টুকরো করতে হবে। পরিমাণমতো পানি ফুটিয়ে নিন। ফুটন্ত পানিতে টুকরো খড়গুলো এক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। এতে খড়গুলো জীবাণুমুক্ত হবে। পানি থেকে তুলে চিপে পানিশূন্য করে একটি পাত্রে রাখুন
পলিথিনের পাঁচটি ব্যাগ নিন। একটি ব্যাগের ভেতরে প্রথমে কিছু খড় বিছিয়ে দিন। খড়ের ওপর মাশরুম বীজ দিন
এভাবে একটি পলিব্যাগের চার স্তরে খড় আর মাশরুম বীজ দিতে হবে। শেষ স্তরে খড় বিছিয়ে দিন
খুব শক্ত করে পলিব্যাগ বাঁধুন
এমনি করে খড় আর মাশরুম বীজ দিয়ে সব ব্যাগ বাঁধুন
প্রতিটি পলিব্যাগের চারদিকে ১০ থেকে ১২টি ছিদ্র করুন
১৫ থেকে ১৮ দিন পর ব্যাগগুলো খুলে ফেলুন
প্রতিদিন চার থেকে পাঁচবার করে পানি ছিটিয়ে দিন
তিন থেকে চার দিন পর চারদিক দিয়ে মাশরুমের অঙ্কুর গজাতে শুরু করবে
চার থেকে পাঁচ দিন পর খাওয়ার উপযোগী মাশরুম গোড়া থেকে তুলে নিন
এ দুই পদ্ধতিতে মাশরুম চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। প্রতিটি পলিব্যাগ থেকে আধা কেজি মাশরুম পাওয়া যাবে। পাঁচটি ব্যাগ থেকে আড়াই কেজি মাশরুম উৎপন্ন হবে। বেশি মাশরুম পেতে হলে চাষের সময় সাবধান থাকতে হবে।
জাত
মাশরুমের কয়েক হাজার জাত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আট থেকে ১০টি জাতের মাশরুম বাণিজ্যিক চাষাবাদ করা হয়। দেশের আবহাওয়া মাশরুম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশে চাষ উপযোগী মাশরুমের মধ্যে রয়েছে ঝিনুক মাশরুম, দুধ মাশরুম, কান মাশরুম, বোতাম মাশরুম, শিতাকে মাশরুম, খড় মাশরুম প্রভৃতি। দেশে বাণিজ্যিকভাবে ঝিনুক মাশরুমের চাষ তুলনামূলক বেশি হয়।
পরিচর্যা
বেডে বীজ বপনের পর থেকে মাশরুম গজানোর আগ পর্যন্ত তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার মধ্যে রাখতে হবে। মাশরুম গজাতে শুরু করলে তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে রাখতে হবে
পলিথিন দ্বারা ভালোভাবে ঢেকে তাপ বাড়ানো যায়। খুলে দিয়ে তাপ কমানো যায়। কাজেই অবস্থার পেরিপ্রেক্ষিতে তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
মাশরুম বেডকে পোকামাকড় ও জীবজন্তুর উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে হবে
বেডটি যেন সব সময় ভেজা থাকে। বেডের উপরিভাগ শুকিয়ে গেলে মাঝে মাঝে হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
সাবধানতা
বীজের পলিব্যাগে কোনোভাবেই সূর্যের
আলো পড়তে দেওয়া যাবে না। সব সময় ঘরটি ঠাণ্ডা রাখতে হবে। খুব বেশি গরম পড়লে ঘরের চারদিকে বস্তা ঝুলিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে
মাশরুম চাষের ঘর ও এর বাইরের চারদিক সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। অপরিচ্ছন্ন জায়গায় মাশরুম ফ্লাই নামের পোকার উপদ্রব শুরু হতে পারে
কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
মাশরুমে মাছির প্রকোপ দেখা দিতে পারে। এজন্য ম্যালাথিয়ন (শূন্য দশমিক এক শতাংশ) স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ফর্মালিডিহাইডে (চার শতাংশ) তুলা ভিজিয়ে সানস্ট্রেটে ঘসে দিলে সবুজ, বাদামি বা নীল মোল্ড দূর হবে।
কালজয়ী মাশরুম
মাশরুম অত্যন্ত সুস্বাদু সবজি। প্রাচীনকাল থেকেই এই মুখোরোচক খাবারটির কদর রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভোজনরসিকরা মাশরুমকে স্বর্গীয় খাবারের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
মাশরুমের নিজস্ব স্বাদ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অন্য খাবারের সঙ্গে ব্যবহার করলে এর স্বাদ বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই মাশরুমকে বলা হল পরশস্বাদু খাবার।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে মানুষ মাশরুমকে সুস্বাদু খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে আসছে। প্রাচীন ফারাও সম্রাট মাশরুমকে দেবতার খাবার হিসেবে মনে করতেন। গ্রিকরা মনে করতÑ‘ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ের ময়দানে জয়লাভের জন্য প্রয়োজনীয় শৌর্যবীর্য জোগাতে পারে মাশরুম।’ চাইনিজরা ‘অমরত্বের সন্ধানে’ মাশরুম খাওয়া শুরু করে। কয়েকটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, মাশরুম হচ্ছে মান্নার নির্যাস থেকে উৎপন্ন অত্যন্ত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন খাবার। ছত্রাকবিদদের মতে মাশরুম থেকেই ‘মাইকোলজি’ শব্দটি এসেছে।
পুষ্টিগুণ
পুষ্টি বিচারে মাশরুম উন্নত খাবার। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় যেসব উপাদান প্রয়োজনীয়; যেমন প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল প্রভৃতি এ খাবারে রয়েছে। ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট এতে নেই বললেই চলে।
প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো মাশরুমে পাওয়া যায় ২৫ থেকে ৩৫ গ্রাম আমিষ, ৫৭ থেকে ৬০ গ্রাম ভিটামিন ও মিনারেল, পাঁচ থেকে ছয় গ্রাম শর্করা ও চার থেকে ছয় গ্রাম চর্বি।
মাশরুমের প্রোটিন উন্নতমানের। এতে মানব দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ৯টি অ্যামিনো এসিডের উপস্থিতি রয়েছে। এই প্রোটিনের বিপরীতে ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটের সর্বনি¤œ উপস্থিতিসহ কোলেস্টেরল ভাঙার উপাদান লোভাস্টাটিন, অ্যান্টাডেনিন, ইরিটাডেনিন ও নায়াসিন থাকায় কোলেস্টেরল জমার ভয় থাকে না।
মাশরুমের ফ্যাট অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড দিয়ে তৈরি, যা দেহের জন্য উপকারী। এছাড়া স্ফিঙ্গলিপিড ও আরগেস্টেরল থাকায় এর মান আরও উন্নত। স্ফিঙ্গলিপিড থাকায় হাড়ের মজ্জা ও ব্রেন ডেভেলপমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আরগেস্টেরলের উপস্থিতির কারণে ভিটামিন-ডি সিনথেসিসে সহায়ক হয়, যা হাড় ও দাঁত তৈরিসহ ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়া মাশরুমের ফ্যাটে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লিনোলিক এসিড রয়েছে, যা শরীর সুস্থ রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
মাশরুমে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম এবং তা পানিতে দ্রবনীয়। ফলে মাশরুমের কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
মাশরুমে রয়েছে অধিকাংশ পলিস্যাকারাইডÑ যেমন গ্লাইকোজেন, বেটা-ডি-গ্লুক্যান, ল্যাম্পট্রোল, লোভাস্টাটিন, অ্যান্টাডেনিন, ইরিটাডেনিন, ট্রাইটারপিন, অ্যাডিনোসিন, ইলুডিন প্রভৃতি। এসব উপাদান দেহের জটিল রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মাশরুমে আঁশের পরিমাণও বেশি। জাতভেদে ১০ থেকে ২৮ আঁশ পাওয়া যায়। ফলে ডায়াবেটিকস রোগীদের ইনসুলিনের চাহিদা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এর।
ভিটামিন ও মিনারেলের উৎস হিসেবে মাশরুমের অবস্থান বেশ ভালো। শুকনো মাশরুমে ৫৭ থেকে ৬০ শতাংশ ভিটামিন ও মিনারেল বিদ্যমান।
মাশরুম দিয়ে তৈরি মজাদার খাবার
ফ্রাই
সবজি
সালাদ
আচার
চিংড়ি মাশরুম
চপ
চিকেন স্যুপ