নিজস্ব প্রতিবেদক: দুই বছর তদন্ত শেষে গুলশানের হলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা হয়েছে। তদন্তে ওই ঘটনায় ২১ জনের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। জড়িতদের পাঁচজন ওইদিন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে। আর বাকি আটজন পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়। অন্যদিকে জীবিত বাকি আটজনের মধ্যে ছয়জন গ্রেফতার হয়েছে, বাকি দুজন এখনও পলাতক। এছাড়া ওই ঘটনায় ৭৫টি আলামত আদালতে পাঠানো হয়েছে।
মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গতকাল সকালে মিন্টো রোডে এক সংবাদ সম্মেলনে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ওই অভিযোগপত্র আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে, সরকারকে কোণঠাসা করতে, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত করতে ও বিদেশি ক্রেতারা যেন চলে যায় এসব কারণে হলি আর্টিজানে ওই হামলা চালানো হয়। এখানে সরাসরি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে জঙ্গিদের ওই হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্য ছিল। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী থেকে প্রযুক্তিগত সুবিধা পেতেই তারা ওই হামলা চালিয়েছে। জঙ্গিরা বিভিন্ন জায়গায় রেকি করেছিল। ছয় মাস আগে থেকে তাদের পরিকল্পনা ছিল। হলি আর্টিজানে প্রচুর বিদেশি নাগরিক খাওয়া-দাওয়া করতে আসতেন। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রায় ছিলই না। তাই এ রেস্টুরেন্টকে তারা বেছে নেয়। এছাড়া ওইদিন ছিল শুক্রবার, ২৭ রমজান, বেশি সওয়াব পেতে তারা ওইদিন হামলা চালায়।’
এদিকে আলোচিত ওই মামলায় গ্রেফতার হওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ। ফলে তাকে মামলার অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
অভিযুক্তদের জীবিত আটজনের মধ্যে রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাতকাটা সোহেল মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা জেলে রয়েছে। এছাড়া শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন নামে দুজন পলাতক রয়েছে।
সূত্র জানায়, হামলার দিনই হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনীর অপারেশন থান্ডারবোল্টে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল নিহত হয়। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশ সদর দফতর ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ মারা যায় তামিম। এছাড়া পরিকল্পনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে সরোয়ার জাহান ওরফে আবদুর রহমানের নাম উল্লেখ রয়েছে। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় সরোয়ার জাহানের বাড়িতে র্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পালাতে গিয়ে নিচে পড়ে নিহত হয় সরোয়ার। আর গুলশান হামলায় হামলাকারীদের আশ্রয় ও অর্থের জোগানদাতা হিসেবে তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদের নাম এসেছে। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুর এলাকায় সিটিটিসির এক অভিযানে নিহত হয় তানভীর কাদেরী। একইভাবে পরিকল্পনাকারীর সহযোগী নূরুল ইসলাম মারজান ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক সহযোগীসহ নিহত হয়। শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর সহযোগী বাশারুজ্জামান চকোলেট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সিটিটিসির জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। আর গুলশান হামলায় অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহের সঙ্গে জড়িত মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজানও বাশারুজ্জামানের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মারা যায়। এদিকে গুলশান হামলায় প্রশিক্ষক হিসেবে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জাহিদুল ইসলামের তদন্তে নাম এসেছে। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে জাহিদ নিহত হয়। জাহিদের সহযোগী রায়হান কবির ওরফে তারেক ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে আট সহযোগীসহ নিহত হয়।
এদিকে হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনায় মোট সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে ২১১ জনের। এর মধ্যে ১৪৯ জন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। এর বাইরে বিভিন্ন সংস্থার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তা ও ফরেনসিক পরীক্ষকদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ওই ঘটনায় হাসনাত করিম, সাইফুল চৌকিদার ও শাওনের জড়িত থাকার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। ওই রাতে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। পরে পুলিশ ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন রেস্তোরাঁ কর্মী মারা যান।
জড়িত ২১ জনের মধ্যে আটজনের নামে চার্জশিট
