ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন সিএসই

শেখ আবু তালেব: বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ, নিয়ম না মেনে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়, শর্ট সেল, সিকিউরিটজ আইন লঙ্ঘন, উচ্চ আদালতের আদেশ পালনে ব্যর্থ ও কমপ্লায়েন্স কার্যক্রম পরিপালনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সিলেট মেট্রো সিটি সিকিউরিটি হাউজ। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জারি করা কারণ দর্শানোর নোটিসের জবাব ও শুনানির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে সিএসই।
সূত্রমতে, সিএসইর তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সিলেট মেট্রো সিকিউরিটিজ। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সিকিউরিটজ আইনের ১৬টি ধারা লঙ্ঘন ও আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান। পরে এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে সিএসই। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালনা পরিষদের সব সদস্য ও কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস এবং সশরীরে সিএসইতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে ডাকা হয়।
গত ১২ জুলাই সিলেট মেট্রোর কর্মকর্তারা সিএসইতে হাজির হয়ে আনিত অভিযোগের ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু তাদের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি সিএসইর কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানটিকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন সিএসইর চিফ রেগুলেটরি অফিসার মোহাম্মাদ শামসুর রহমান।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আপনাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিপরীতে শুনানিতে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। উচ্চ আদালতের আদেশ ও সিএসইর নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছেন। আপনাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা হতাশ হয়েছি। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছি। গত ১৫ জুলাই এ চিঠি পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে শেয়ার বিজ পত্রিকার পক্ষ থেকে সিলেট মেট্রো সিটির সিএসই প্রতিনিধি ফারুক আহমেদ মিসবাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বিষয়টি জানানোর পরে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা সবকিছুই করব। বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সিএসইর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সিএসইর অনুমোদিত নির্দেশনা না মেনেই সিলেট মেট্রো সিটি বুথ চালু ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিষয়টি নিরীক্ষকের কাছেও ধরা পড়ে, যা নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ বছর পর্যন্ত সময়ে নিরীক্ষা করে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিএসইর বেঁধে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বুথ ও শাখার কার্যক্রম পরিচালনা করছে না ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির সব বুথ ও শাখা থেকেই ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে শেয়ার ‘শর্ট সেল’ করা হয়েছে। সাউথইস্ট ব্যাংকের চট্টগ্রামের চৌহাটা শাখায় অনুমোদন ছাড়াই সিসিবিএ হিসাব খোলা ও পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া অনুমোদন ছাড়াই একাধিক ব্যাংকের শাখায় এরকম হিসাব খোলা হয়েছে।
অন্য অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শেয়ার লেনদেন করতে প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা একই আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছেন সব কম্পিউটারে। যদিও প্রত্যেকের পৃথক আইডি ও পাসওয়ার্ড রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকেরই নিজেদের আইডি দিয়ে শেয়ার লেনদেন করতে হবে।
আলোচিত সময়ে দুই কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার ১২৬টি শেয়ার শর্ট সেল করা হয়েছে। শেয়ারের মোট মূল্য ৮১ কোটি ৪২ লাখ ১২ হাজার ১৫০ টাকা দেখানো হয়, যার ৪৪ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ হয়েছে প্রধান শাখার মাধ্যমে। কিন্তু এর বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ৫৯ কোটি ১০ লাখ ৯৫ হাজার ৮১৯ টাকা পরিশোধ করা হবে বলে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এভাবে ২২ কোটি ৩১ লাখ ১৬ হাজার ৩৩১ টাকা কাদের দেওয়া হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ শেয়ার মূল্যের পুরোটাই বিনিয়োগকারীর। এই পরিমাণ অর্থ কম দেওয়ার কারণে ব্যাখ্যা দিতে পারেনি সিলেট মেট্রো সিটি সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানটি। সব শেয়ারের বিপরীতে ৮১ কোটি ৪২ লাখ ১২ হাজার ১৫০ টাকা দেখানো হয় পরিশোধযোগ্য হিসেবে। সব শেয়ারের গড় আয় দেখিয়ে মোট মূল্য দেখানো হয়। কিন্তু শেয়ারভেদে বিস্তারিত দর উল্লেখ করা হয়নি।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিনিয়োগকারীরা ৬৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫২ টাকা পাবেন। আলোচিত শেয়ারের সর্বনিন্ম মূল্য দেখিয়ে এ হিসাব করা হয়েছে। এভাবে আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে। এছাড়া আরও তিন কোটি চার লাখ ৭০ হাজার ১৬৮ টাকার কমিশন ও অন্যান্য ফি অন্যায়ভাবে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত সিলেট মেট্রো সিটি সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম বন্ধ করেছিল সিএসই। পুনরায় ১৩ অক্টোবর চালু করে দেওয়া হয়। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম বন্ধ থাকার কথা ছিল। কিন্তু সিএসই দেখতে পায়, এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু লেনদেন করেছে। বছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মূলধন ঋণাত্মক দেখতে পেয়েছে সিএসই।
আর্থিক অনিয়ম বের করতে নমুনা হিসেবে কয়েকজন গ্রাহকের হিসাব পরীক্ষা করা হয়। এ সময়ে সিএসই দেখতে পায়, ওই গ্রাহক তিন লাখ টাকার একটি চেক তার হিসাবের বিপরীতে জমা দেন গ্রাহক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক বিবরণীতে দেখানো হয়, ওই চেকের বিপরীতে জমা দেখানো হয় ৩৩ লাখ টাকা। একই গ্রাহক ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে নগদ ২০ লাখ টাকা জমা দেন। কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদনে জমা দেখানো হয়েছে ২১ লাখ টাকা।
আরেক ভাউচারে ১৭ লাখ টাকার বিপরীতে জমা দেখানো হয়েছে এক লাখ টাকা। অনেক গ্রাহকের বিও হিসাবে টাকা না থাকার পরেও অর্থ উত্তোলন করেছেন। নিজ বিও হিসাবে অর্থ না থাকার পরেও এক গ্রাহক আরেক গ্রাহকের হিসাবে অর্থ পাঠিয়েছেন। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ‘আলমারজান’ বুথ অনুমোদন ছাড়াই বিকল্প অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা সবকিছুই করব। তাদের বক্তব্য শোনা হয়েছে। এ বিষয়ে গঠিত কমিটি কাজ করছে। বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০