নিজস্ব প্রতিবেদক: নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিপরীতে এবার সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি, পিক-আপ, সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচলেও বাধা প্রয়োগ করেছে তারা। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করে পরিবহন শ্রমিকদের মহড়া দিতে দেখা গেছে। তাদের সঙ্গে সরকার-সমর্থিত বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনও যোগ দেয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা।
খবর নিয়ে জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দেশের কোথাও দূরপাল্লার কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। সেইসঙ্গে ঢাকামুখী বাসও বন্ধ রাখেন বিভিন্ন জেলার পরিবহন মালিকরা। কোনো কর্মসূচি ডাকা না হলেও পরিবহন মালিকরা বলছেন, সড়কে ভাংচুরের কারণে পরিবহন শ্রমিকরা বাস চালাতে চাইছেন না। অন্যদিকে পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, মালিকরা বাস নামাতে নিষেধ করায় তারা বাস চালাচ্ছেন না।
সরজমিনে গতকাল সকালে রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, পরিবহন শ্রমিকরা জনপদ মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে সব ধরনের যানবাহন আটকে দিচ্ছেন। এ সময় কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি ও সিএনজি অটোরিকশাকে ফিরিয়ে দেন তারা। সেখানে কথা হয় এক পরিবহন শ্রমিকের সঙ্গে। তার দাবি শিক্ষার্থীরা তাদের শত শত বাস ভাঙ্চুর করেছে। তাই তারা রাস্তা বন্ধ রেখেছে। শিক্ষার্থীরা রাস্তা থেকে চলে গেলে তারাও গাড়ি চালানো শুরু করবে। এছাড়া রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড, কমলাপুর, মতিঝিল, আরামবাগ, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন সড়কে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা গেছে।
শিক্ষার্থীরা যেন রাস্তায় নামতে না পারে এবং কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেজন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের শক্ত অবস্থানও দেখা গেছে। দনিয়া কলেজ, শাহবাগ মোড়, মতিঝিল শাপলা চত্বর, কারওয়ান বাজার মোড়, ফার্মগেট এলাকা, মিরপুরসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় সুসজ্জিত অবস্থায় পুলিশকে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
এদিকে রাস্তায় পরিবহন সংকটের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। দুই-তিনগুণ ভাড়া দিয়ে তাদের গন্তব্যে যেতে হয়েছে। সারা দিনে কয়েকটি বিআরটিসি বাস ছাড়া কোনো গণপরিবহন চোখে পড়েনি। যাত্রীদের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় পিকআপ, রিকশা, ভ্যান ও অটোরিকশা। কিন্তু সুযোগ বুঝে বাড়তি ভাড়া হাঁকাতে থাকেন এসব পরিবহনের শ্রমিকরা। পিকআপে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া রাখা হয় ২০ টাকা, মহাখালী পর্যন্ত ৩০ টাকা আর বনানী পর্যন্ত ৪০ টাকা।
এ বিষয়ে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে পরিবহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা রহমত মিয়া বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে ভেঙে ভেঙে এখান পর্যন্ত আসতে ৮০ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ বাসে এলে খরচ হতো ১৫ টাকা। আরেক যাত্রী বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আমরা কোথায় যাব। আমরা তো পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে গেলাম।
তবে অনেক পরিবহন শ্রমিকই এমন ধর্মঘটের সঙ্গে একমত নন। শুধু মালিক ও সমিতির ভয়ে তারা বাস চালানো বন্ধ রেখেছেন। এ বিষয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসচালক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা তো গাড়ি চালাতে চাই। কিন্তু রাতেই নেতারা নিষেধ করে দিয়েছেন যেন আজ গাড়ি না বের করি। গাড়ি না চালালে খাব কী, বউ-বাচ্চাকে খাওয়াবো কী? সব ড্রাইভারই তো আর খারাপ নয়।’
উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বেশ কিছু গাড়ি ভাঙ্চুর হয়। সমালোচনার মুখে পড়েন পরিবহন শ্রমিকদের নেতা নৌমন্ত্রী শাজাহান খানও। গত বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে যানবাহনের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে শুরু করে। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ তাদের লাঠিচার্জও করে।
ওই দিনই সন্ধ্যায় সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা জানিয়ে তাদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানান। এমন পরিস্থিতিতেই গতকাল ভোর থেকে সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিকরা।
তবে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়ত উল্লাহ দাবি করেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সঙ্গে তারাও একমত, কিন্তু রাস্তার নিরাপত্তার কথা ভেবে শ্রমিকরা বাস বের করছেন না। তিনি দাবি করেন, গাড়ি না চালানোর জন্য মালিকদের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
এ সময় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় ও দূরপাল্লায় বাস চলাচলের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, এটা কোনো ধর্মঘট নয়, নিরাপত্তার অভাবে মালিক-শ্রমিকেরা দিনের বেলায় বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। তবে রাতের বাস চলছে। আজও চলবে। তিনি বলেন, আজ শুক্রবার যে পরিস্থিতি ছিল, সেই পরিস্থিতি শনিবার থাকলে, সকাল থেকেই বাস চলবে।
সারা দেশে অঘোষিত বাস ধর্মঘট যাত্রীদের ভোগান্তি
