মিজানুর রহমান শেলী: গত ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক বিনিয়োগ ধারণাগুলোকে ফাইন্যান্স থিওরি বলে ডাকা হচ্ছে। এটা একগুচ্ছ ধারণা, যা অতি সাধারণ ও পথভ্রান্ত জটিলতার বরফ গলিয়ে দেয়। পাবলিক সিকিউরিটিজে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নিয়ে পড়ালেখা করাটা অর্থহীন বা সময় অপচয়ের নামান্তর। এই মতানুসারে, আপনি আপনার বিনিয়োগের পরিসর বাড়ানোর জন্য স্টক টেবিলের ওপর ভাগ্য তীর ছুড়ে একগুচ্ছ স্টককে এলোমেলোভাবে নির্বাচন করতে পারেন। এটা ব্যক্তিগত বিনিয়োগের লাভ-ক্ষতির হিসাবে ঠিক-বেঠিকের চিন্তা করার চেয়ে উত্তম।
আধুনিক যুগের যাবতীয় ফাইন্যান্স থিওরির মধ্যে মডার্ন পোর্টফোলিও থিওরিই প্রধান। বলা হয়ে থাকে বৈচিত্র্যপূর্ণ পোর্টফোলিও ধারণ করতে পারলে যে কোনো মুহূর্তে সিকিউরিটিজের যে কোনো উৎকট আকস্মিক ঝুঁকিগুলো এড়ানো সম্ভব হয়। আর তাই এই থিওরিতে লোক স্লোগানকে তত্ত্বীকরণে আনা হয়েছে, বলা হয়েছে ‘তোমার ডিমগুলোকে একটি বাক্সে বন্দি করে ফেলো না’। ঝেড়ে ফেলা ঝুঁকিই একমাত্র ঝুঁকি, যার কারণে বিনিয়োগকারীদের খেসারত দিতে হয়। আসলে গল্প বহমান।
এই ঝেড়ে ফেলা ঝুঁকিকে একটি সহজ গাণিতিক পরিভাষায় মাপা যায়। এর নাম হলো বেটা। এখানে দেখানো হয়, বাজারের তুলনায় সিকিউরিটি কতটা পরিবর্তনশীল বা উদ্বায়ী। সহজে উবে যায়। কার্যকরী বাজারে যেসব সিকিউরিটি বাণিজ্য চালায়, সেসব সিকিউরিটির এসব উদ্বায়ী ঝুঁকিগুলোকে বেটা খুব ভালোভাবে পরিমাপ করতে পারে। কেননা এসব বাণিজ্যে জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসার তথ্যাদি খুব দ্রুত ও সঠিক উপায়ে মূল্যমানে পরিণত হয়। আধুনিক ফাইন্যাস্ট স্টোরিতে বাজারের বিধিবিধান কার্যকরী হয়ে ওঠে।
এসব তত্ত্বীয় ধারণাগুলো কেবল আইভরি টাওয়ার একাডেমি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজনেস স্কুল ও আইন স্কুলের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ নয়। বরং এগুলো গত ৩৫ বছর ধরে ফাইন্যান্সিয়াল আমেরিকায় একটি স্ট্যান্ডার্ড ডগমা বা আদর্শ মতবাদে পরিণত হয়েছে। এর পরিধি বিস্তৃত: ওয়ালস্ট্রিট থেকে মেইন স্ট্রিট অবধি। অনেক পেশাদারীরাই এখনও বিশ্বাস করেন, স্টক মার্কেটের দর সবসময় প্রাথমিক মূল্যমানকে প্রতিফলিত করে। আর এটাই হলো এখানকার একমাত্র ঝুঁকি। এটি দরদামের উদ্বায়িতা বা হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তশীলতা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সব সময় একটি সন্দেহ-দ্বিধা কাজ করে। আর এ সংকট সমাধার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বিচিত্র সব গুচ্ছ স্টকে বিনিয়োগ করা।
বিনিয়োগকারীদের আলাদা আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হলো গ্রাহাম ও ডডের দিকে ফিরে যাওয়া। এটা যুক্তি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে স্ট্যান্ডার্ড ডগমার ভ্রান্তিকে অপসারণ করতে সক্ষম হয়। বাফেট মনে করেন, বেশিরভাগ বাজারই পুরোপুরি কার্যকর নয় এবং এর সঙ্গে থাকে সমপরিমাণ উদ্বায়িতা ও ঝুঁকি; সবমিলে একটি গড়পড়তা এলোমেলো বিমূর্ত অবস্থা সৃষ্টি করে। এসব কারণে বাফেট এমবিএ ও জেডি প্রজন্ম নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন বোধ করেন। কেননা তারা আধুনিক ফাইন্যান্স থিওরির প্রভাবে প্রভাবান্বিত যেসব শিক্ষা গ্রহণ করছে তার সবই ভুলে ভরা এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সেখানে অনুপস্থিত।
আধুনিক ফাইন্যান্স থিওরির সবচেয়ে দামি শিক্ষাটি এসেছে পোর্টফোলিও ইন্স্যুরেন্সের বিস্তারণ থেকে। এটা এমন এক কম্পিউটারাইজড কৌশল, যার মাধ্যমে অধঃপতিত বাজারে একটি পোর্টফোলিওকে পুনর্বিন্যাস করা হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে স্টক মার্কেট ধসের পরিস্থিতিকে প্রচণ্ডভাবে আরও বেশি থিতিয়ে দিতে পোর্টফোলিওর পাঁচমিশালি ব্যবহার সহায়তা করেছিল। এমনকি এটি ১৯৮৯ সালেও বাজার পতনে ভূমিকা রেখেছিল। তবুও এর একটি আশার আলো রয়েছে, এটা মডার্ন ফাইন্যান্সের গল্প চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিজনেস ও ল’ স্কুলেও এখন এটার আলোচনা চলে। ওয়াল স্ট্রিটেও এখনও অনেকে এটার অনুসরণ করে।
মডার্ন ফাইন্যান্স থিওরিতে বাজার উদ্বায়িতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। আবার ছোট ছোট মূলধনি স্টক, হাই ডেভিডেন্ড-ইয়েল্ড স্টক ও লো-প্রাইস রেশিও স্টকের আচরণ সম্পর্কিত অন্যান্য দশাকেও প্রকাণ্ড করে তোলা সম্ভব হয়নি। ১৯৯০-এর দশকে এবং ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে বাজার ব্যবস্থায় ‘পিস ডি রেডিজস্ট্যান্স’ ছিল প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট স্টক বাবল এটাকে বিস্তৃত করেছিল। স্টক প্রাইসের চক্রাকার আবর্তনের মাধ্যমে এর বাজারজাত হয়েছিল। কখনও রমরমা আবার কখনও বিষাদ পরিস্থিতির মধ্যে এটি লাফালাফি করছিল হয়েছিল। তবে ব্যবসায় মূল্যের সঙ্গে এর কোনো দূরবর্তী যোগসূত্র ছিল না। তবে হঠাৎ করেই সংশয়বাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তারা বলতে শুরু করল সত্যিকার অর্থে বেটা কখনোই কার্যকর বিনিয়োগ ঝুঁকিকে চিহ্নিত করতে পারে না। এমনকি ক্যাপিটাল মার্কেট সত্যিই বেটাকে যে কোনো উপায়ে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য যথাযথ ফলপ্রদ নয়।
এসব আলোচনাকে আরও বাড়ন্ত করে তোলার জন্য জনগণ বাফেটের সফল বিনিয়োগ কাহিনী জানার চেষ্টা শুরু করল। এমনকি বাফেট যে ব্যবসা ও বিনিয়োগের প্রয়োজনে গ্রাহাম-ডডের কৌশলে ফিরে গেলেন সেই পদ্ধতিও লোকে খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবলোকন করতে থাকলেন। মোটের ওপর ৪০ বছরের মধ্যে বাফেট গড়ে ২০ শতাংশ বার্ষিক রিটার্ন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি প্রতিবেদনে এর চেয়েও ভালো অবস্থান চোখে পড়ে। ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে বে গ্রাহামের গ্রাহাম-নিউম্যান কর্প. একই সাফল্য পেয়েছিল। গ্রাহাম-নিউম্যানের চোখ ধাঁধানো কর্মনৈপুণ্য আর বার্কশায়ারের বৈচিত্র্যের প্রতি বেশ গুরুত্বারোপ করে বলেন, স্যাম্পল সাইজ ছিল বেশ বড়। একটি বিস্তৃত সময় ফ্রেমের মধ্য থেকে এটি পরিচালিত হয়েছে। তবে কোনো আকস্মিক কপালী অভিজ্ঞতাকে পুুঁজি করে এর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়নি। আবার কোনো উপাত্ত খননের কাজও পরিচালিত হয়নি। কর্মনৈপুণ্য ছিল অনুদৈর্ঘ্য, তবে অবশ্যই এটা সংগঠনের পরের উপলব্ধির মতো পথ অবলম্বন করেনি।
বাফেটের কর্মনৈপুণ্যকে হুমকি হিসেবে বোধ করলেন মডার্ন ফাইন্যান্স থিওরির একগুয়ে ভক্তরা। তারা এ সময় গোঁ ধরে অবাক করা সব ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করল বাফেটের কর্মকুশলতা নিয়ে। তারা বলতে চাইল, বাফেট হলো একজন ভাগ্যসুপ্রসূত মানুষ। অনেকটা হ্যামলেটের বানরের মতো। অথবা গুরু তথ্যের ভেতরে ঢোকার কোনো অধিকার ছিল বাফেটের, যা অন্য বিনিয়োগকারীর ছিল না। বাফেটের কাজকে মলিন করে তোলার জন্য মডার্ন ফাইন্যান্সের একগুয়ে অনুসারীরা বেটা বা ডার্ট থিওরির লাগাম লাগাতার টেনে ধরে বসে থাকল। তারা বলতে থাকল, একজন বিনিয়োগকারীর সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশল হলো বেটা বা ডার্ট থিওরির কৌশল ব্যবহার করে বৈচিত্র্য অবলম্বন করা এবং একই সঙ্গে নিয়মিত বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও পুনঃকাঠামোবদ্ধ করা।
বাফেট এর সরস মন্তব্য করেছিলেন। আর কিছু উপদেশ রেখেছিলেন তাদের জন্য। তার রসিকতা ছিল, সেসব বিনিয়োগ মতবাদের ভক্তদের উচিত কোনো কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অধ্যাপকের চেয়ারে বসা, যাতে করে তারা কার্যকরী মার্কেট ডগমা নিয়ে শাশ্বত পাঠদান-বাণী চিরন্তন নিশ্চিত করতে পারেন। আর উপদেশটা ছিল, মডার্ন ফাইন্যান্স থিওরি ও অন্যান্য আপাত বুদ্ধিসম্পন্ন মতামতকে এড়িয়ে চলা এবং বিনিয়োগের সঙ্গে লেগে থাকা। এটা হতে পারে অনেক লোকের জন্য ইনডেক্স ফান্ডে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সর্বোত্তম কাজ। অথবা এটা তারা গভীরভাবে মাথা খাটিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগকারী যোগ্যতা মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সম্ভব করতে পারে। এ ধরনের চিন্তায়, ঝুঁকি কোনো বেটা বা উদ্বায়ী বিষয় নয় বরং একজন বিনিয়োগকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা।
এই দর্শন রচনাবলি সম্পাদনা করেছেন লওরেন্স এ. কানিংহাম।
অনুবাদক: গবেষক, শেয়ার বিজ।