সোহেল রানা: আরবীয়রা জাতীয়তাবাদের প্রচুর গল্প শোনায়। কিন্তু তাদের কথিত ঠুনকো জাতীয়তাবাদের অগ্নিপরীক্ষা হয়ে গেছে প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধেই। ৪৮-এর সে যুদ্ধই ইসরাইল রাষ্ট্রের ভিত গড়ে দেয়। ১৯৪৮ সালে নাকবাতে প্রায় সাড়ে সাত লাখের মতো ফিলিস্তিনি ভিটেমাটি হারায়। সে সময় সংখ্যার বিচারে এটি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাসরত আরব জনগোষ্ঠীর ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। এ সময় হয় ধ্বংস, না হয় দখল করা হয় ৫০০’র মতো ফিলিস্তিনি গ্রাম। ১৯৪৮-এ ফিলিস্তিনের প্রায় ৫৬ শতাংশ জায়গা নিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। জেরুজালেম ও হাইফা নিয়ে নেওয়া হয়। লিদ্দা ও রামাল্লা থেকে ৫০ হাজারের মতো ফিলিস্তিনিকে পশ্চিম তীরের দিকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরের মাসে দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন তার মন্ত্রিসভাকে বললেন, ‘আরবদের ফেরত আনা যাবে না।’ অবশ্য ৫৬ সালের দিকে ফিলিস্তিনিরা তাদের বাড়িঘরে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যারাই ফিরতে চেয়েছিলেন, তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। এদের কেউ কেউ মারা গেছেন। তারও আগে ১৯০০ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের মোট জনগোষ্ঠীর ৯৬ ভাগ ছিল আরব গোষ্ঠীর; বাকি চারভাগ ছিল ইহুদি। বর্তমানে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ফিলিস্তিনি বিভিন্নভাবে তাদের বাস্তুচ্যুতি ঠেকাতে পেরেছিলেন। এরকম সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখের মতো, যারা ইসরাইলের ভেতরে বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছেন। এর বাইরে লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান এবং ইসরাইল অধিকৃত গাজা ও পশ্চিম তীরের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছেন। ইসরাইল অভ্যন্তরে যেসব ফিলিস্তিনি রয়েছেন, তারা ইসরাইল ভূখণ্ডের বাইরে যারা আছেন, তাদের মতোই দিনযাপন করছেন।
ইহুদিরা ভাবত বা এখনও ভাবে জেরুজালেম ছাড়া ইহুদি রাষ্ট্রের কোনো অর্থ নেই। মর্যাদাপূর্ণ এ শহর ছাড়তে চায়নি মুসলমানরাও। ১৯৪৮-এ তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরাইলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। আর কিছুদূর এগোলেই মিসরীয় বাহিনী তেলআবিবের কাছাকাছি চলে যেতে পারত। কিন্তু তা আর হয়নি। জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় আর এতেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। যুদ্ধবিরতির সময় দু’পক্ষই শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু পরিস্থিতি ইসরাইলের পক্ষে চলে যায়Ñযখন চেকোসেøাভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান এসে পৌঁছায় ইহুদিদের কাছে। যুদ্ধবিরতি শেষ হলে নতুন অস্ত্রে সজ্জিত ইসরাইলি বাহিনী পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরবদের ওপর। তেলআবিব ও জেরুজালেমের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। জাতিসংঘের মাধ্যমে আরেকটি যুদ্ধবিরতিতে সে সংঘাত থামে।
কেবল অস্ত্র সংকটই আরবদের পরাজয়ের মূল কারণ নয়; বরং আরব শাসকদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা না থাকাতেই ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছে এবং ইসরাইল রাষ্ট্র স্থায়ী হতে পেরেছে। এরপর থেকে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অতি দ্রুত উন্নতি লাভ করে ইসরাইল।
১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে অটোমান সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম নিয়ে নেয় তারা। তখনই ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনে তারা সহায়তা করবে। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি নেতা ধনকুবের ব্যারন রথসচাইল্ডকে। সে চিঠি ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ হিসেবে পরিচিত। ইহুদিদের কাছে ব্রিটেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলÑফিলিস্তিনের জমিতে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দেবে। ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটি তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। ১৯৩৩ সালের পর থেকে নাজিবাদী হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে দমননীতি শুরু করেন। জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আসতে থাকে। অস্তিত্ব রক্ষায় ফিলিস্তিনি আরবরা বিদ্রোহ করে (১৯৩৩-৩৯)। আরবদের বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করেছে ব্রিটিশ সেনারা। ইহুদিরা তাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনে বদ্ধপরিকর ছিল। ব্রিটেনের সহায়তায় সে অনুযায়ী তারা কাজ এগিয়ে নিচ্ছিল।
১৯৩৯ সালে ব্রিটেন সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়Ñপরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ৭৫ হাজার ইহুদি অভিবাসী আসবে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে। এটি ইহুদিদের মনঃপূত হয়নি; কারণ তাদের চাওয়া ছিল আরও বেশি। একই সঙ্গে ব্রিটেন ও হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করে ইহুদিরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনী দ্বারা লাখ লাখ ইহুদি হত্যার পর ইহুদিদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র জরুরি হয়ে পড়ে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্র–ম্যান ইসরাইল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি চেয়েছিলেন, হিটলারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এক লাখ ইহুদিকে অতি দ্রুত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে জায়গা দেওয়া হোক। এতে করে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কায় ভোগে ব্রিটিশরা। ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনের উদ্দেশে জাহাজে বোঝাই হয়ে আসা হাজার হাজার ইহুদিকে বাধা দেয় ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। ইহুদি সশস্ত্র দলগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর তাদের আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটেন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাড়া দেওয়া। এক সময় বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায় ব্রিটেন। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত জানায় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য; অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। আরবরা এ অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। জাতিসংঘের দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানতত্ত্বে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে গোলযোগ শুরু হয়। তখন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ছেড়ে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সৈন্যরা দিনক্ষণ গুনছিল। ইহুদিরা বুঝতে পেরেছিল, নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর আরবরা একটা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবে। তাই সম্ভাব্য একটি যুদ্ধের জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল তারা। জাতিসংঘ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তাতে জেরুজালেম আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল। কিন্তু আরব কিংবা ইহুদি কোনো পক্ষই সেটি মেনে নেয়নি। ফলে জেরুজালেম শহর নিয়ন্ত্রণে দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল।
প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ ম্যান্ডেট শেষের দিকে ব্রিটিশরাও ফিলিস্তিনিদের দাবি কিংবা চলমান সংঘাতকে কোনো গুরুত্ব দিল না। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে হাইফা বন্দর হয়ে ফিলিস্তিন ছাড়েন সর্বশেষ ব্রিটিশ হাইকমিশনার জেনারেল এলান কানিংহ্যাম। ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হওয়ার আট ঘণ্টা আগেই ১৪ মে বিকালে ইহুদি নেতা ডেভিড বেন গুরিয়ন ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এর পক্ষে সমর্থন আসে যুক্তরাষ্ট্রের। একদিনের ব্যবধানে মিসর, ট্রান্স জর্ডানসহ (বর্তমান জর্ডান) আরব রাষ্ট্রগুলো নতুন রাষ্ট্র ইসরাইল আক্রমণ করে।
পদাতিক ও গোলন্দাজ মিলিয়ে আরবদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের মতো। বিপরীতে ইসরাইল একাই যুদ্ধে নামায় প্রায় ৩৫ হাজার সেনা। ইহুদিরা ধরেই নিয়েছিল, জেরুজালেম ছাড়া ইহুদি রাষ্ট্রের কোনো অর্থ নেই। অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম পবিত্র জায়গা।
আরবরা ভেবেছিল, ইহুদিদের বিরুদ্ধে সহজ একটা জয় পাবে তারা। মিসরের রাজা ফারুকের উপদেষ্টা বরং এ কথা বলছিলেনÑএটা তাদের জন্য একটা কেকের টুকরো হবে। অথচ তারা পরাজিত হলো। কারণ তারা ইসরাইলকে অবমূল্যায়ন করেছিল। আরবরা স্বল্পসংখ্যক সেনা ও সামরিক যান রণাঙ্গনে পাঠায়। অন্যদিকে সংখ্যা ও অস্ত্রের দিকে ইসরাইল সুপিরিয়র ছিল। মিসরীয় সেনারাই বরং সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে তাদের স্বল্প অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া ইসরাইলি সেনারা আরবদের চেয়ে দক্ষ ছিল। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনা ইউনিটে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল তাদের। অনেক ইহুদি স্বেচ্ছাসেবকও যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল; কারণ তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়েছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দ্বিরাষ্ট্রিক প্রস্তাব যেটি পাস হয়েছিল, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুমোদন ছিল। যুদ্ধের সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ইসরাইলকে অস্ত্র দিতে চেকোসেøাভিয়াকে চাপ প্রয়োগ করেছিল।
পরাজয়ের আরও কারণ আরবদের রাজনৈতিক বিভক্তি, সমন্বয়হীনতা ও অনৈক্য। কে আরব বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে এ নিয়ে দুটি ধারা তৈরি হলো। এক পক্ষে মিসর ও সৌদি আরব; অন্যপাশে ট্রান্স জর্ডান ও সিরিয়া। অর্থাৎ ঠিক কারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কাজ করছিল, তা পরিষ্কার ছিল না। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, ট্রান্স জর্ডানের রাজা আবদুল্লার সঙ্গে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডমেয়ারের একটি গোপন চুক্তি হয়েছিল, যার আওতায় পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম ট্রান্স জর্ডানকে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা ছিল। এ কারণেই আরব নেতারা আর এগোননি বলে প্রচার আছে। যুদ্ধের একেবারে প্রথম দিকে মিসরীয় সেনারা গাজা দখলে নেয় এবং খান ইউনুসে তাদের পতাকা ওড়ায়। কিন্তু দ্রুতই আরব নেতারা ভূমি ও মর্যাদার তাগিদে নিজেরাই লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ল। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় হাজার ইহুদি নিহত হয়েছিল। ইসরাইলিরা মনে করে, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ যেভাবে দুটি দেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেটি যদি ফিলিস্তিনিরা মেনে নিত, তাহলে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল নামের দুটি দেশ এখন পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ অবস্থান করত। ইসরাইলের ভাবনা যাই-ই হোক, আরবরা নিজেদের কারণেই ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল টিকে গেছে। প্রতিষ্ঠার ৭০ বছরে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বহুগুণে উন্নতি করেছে ইসরাইল। দেশটি এখন অঘোষিত পরমাণু শক্তিধর ও অপ্রতিরোধ্য মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম আয়রন ডোমের মালিক। বিশ্বে ড্রোন বিপ্লবের সফল অগ্রদূত তারা। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুপারপাওয়ার।
গণমাধ্যমকর্মী
sohel.shalban@gmail.com