শেখ আবু তালেব: একসময়ের শীর্ষ ব্র্যান্ডের কোম্পানি থেকে ঋণের জালে খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠান মুন্নু জুট স্টাফলার। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানিটি এখন অর্থ সংকটে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। নতুন কোনো বিনিয়োগে না গিয়েই কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধি পাচ্ছে লাগামহীন গতিতে। অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধিতে হাল আমলে সবচেয়ে বিতর্কিত কোম্পানিটি এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বিনিয়োগ ঝুঁকির তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিনিয়োগ অবস্থা নিয়ে ডিএসইর মাসভিত্তিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছে। ডিএসইর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন মাস শেষে কোম্পানিটির বর্তমান পিই রেশিও দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৬৭২ দশমিক ৬৯, যা ডিএইতে তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক কোম্পানির মধ্যে সর্বোচ্চ। গত এপ্রিল মাসে যা ছিল তিন হাজার ১৩৭। আর মার্চে ছিল এক হাজার ৬০৭।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগের অবস্থান মূল্যায়নে দেখা হয় প্রাইস আর্নিং রেশিও (মূল্য অনুপাত আয়) বা পিই রেশিও। যে কোম্পানির পিই রেশিও যত কম, তা বিনিয়োগের জন্য তত ভালো। কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ১৫ পর্যন্ত হলে স্বাভাবিক ধরা হয়। পিই ২০-এর ঘর অতিক্রম হলেই বিনিয়োগকারীদের সাবধান হতে বলা হয়। এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পিই রেশিও ৪০ হলে ওই কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে নিষেধাজ্ঞা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
সূত্র মতে, অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধিতে গত গত তিন মাসে তিনবার কোম্পানিটির কাছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জানতে চায় ডিএসই। গত মে, জুন ও জুলাই মাসে একবার করে এমন তথ্য জানতে চওয়া হয়েছে। প্রতিবারই কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য তাদের হাতে নেই। গত এক বছরে কোম্পানিটি এ রকম ছয়টি চিঠি পেয়েছে ডিএসইর পক্ষ থেকে।
জানা গেছে, গত এক বছর ধরেই শেয়ারদর বৃদ্ধিতে থাকা কোম্পানিটির উৎপাদনে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি, যার প্রভাব বার্ষিক প্রতিবেদনে পড়বে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষও বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছে এমন কথা। কিন্তু কল্প কাহিনি ছড়িয়ে এক সময়ে ভালো থাকা কোম্পানিটির শেয়ার ঘিরেই এখন চলছে কারসাজি। একটি চক্র এ শেয়ারের ওপর ভর করেই এখন কোটিপতি হয়েছেন। কারসাজির লাভ তুলেই শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন তারা। বিএসইসিও নীরব দর্শকের মতো দেখছে তা।
সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে থাকার পরও কিছু বিনিয়োগকারীরা এখনও আগ্রহ দেখাচ্ছেন কোম্পানিটিতে, যা পুঁজিবাজারের জন্য একটি ‘দগদগে ঘা’তে পরিণত হয়েছে। এসব স্বল্প কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি বন্ধ করতে সম্প্রতি ডিএসই থেকে তালিকাচ্যুত হয়েছে রহিমা ফুড ও মডার্ন ডাইং। গত ৮ আগস্ট ১৩টি কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে ডিএসই। সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদে আলোচনার পরেই এম উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। সূত্র মতে, আরও ১৭টি কোম্পানিকে পর্যায়ক্রমে চিঠি দেওয়া হবে।
‘জেড’ ক্যাটেগরির এসব কোম্পানিকে চিঠি দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, কোম্পানিগুলো ভবিষ্যতে তালিকাচ্যুতিও হতে পারে। কিন্তু ডিএসইর এমন উদ্যোগেও গত দুই দিনে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারদর কমলেও মুন্নু জুটের শেয়ারদর বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। গতকালও শেয়ারটির দর ২০১৬ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোম্পানিটির পিই রেশিও ৫০০ টাকার শেয়ারটি এখন হাতবদল হচ্ছে চার হাজার ৫১০ টাকায়।
মুন্নু জুটের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি একটি কমিটিও করেছে। তারপরও থামেনি কারসাজি। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বাজারমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে কোম্পানি পরিদর্শন করতে হবে বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে। তারপরও দর বৃদ্ধি না থামলে শেয়ার লেনদেন সাময়িক বন্ধ রাখা যেতে পারে কোম্পানিটির। বিশ্বের অনেক দেশের স্টক মার্কেটের এমন সিদ্ধান্তের নজির রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি গত পাঁচ বছর ধরে নামমাত্র মুনাফা করছে। স্বল্প মূলধনি ওই কোম্পানিটির মোট মাত্র চার লাখ ৬০ হাজার শেয়ারের ৫৫ দশমিক ৯০ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে। আর কারসাজির খবরে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর বর্তমানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ৩৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।