কৃষি ও জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে পাতকুয়া। এর বিভিন্ন দিক তুলো ধরা হলো
পানীয়জলের অভাব এখনও আমাদের দেশে প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি সবখানে। তবে কোথাও কোথাও পানির সংকট চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চলের অবস্থা খুবই করুণ। বর্ষায় ডুবে যায়; বন্যা আর গ্রীষ্মে পানির অভাব দেখা যায় এ অঞ্চলে। খাবার পানিরই যেখানে সংকট, সেখানে চাষাবাদের ভাবনা তো বিলাসিতা বই কিছু নয়। এ সমস্যার সমাধানেই স্বপ্ন দেখাচ্ছে পাতকুয়া। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এ উদ্যোগ কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। এর মাধ্যমে পানীয়জলের পাশাপাশি ও সীমিত আকারে সবজি চাষও করা যাবে।
বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল এক বিশেষ মৃত্তিকা অঞ্চল। তবে অন্যান্য অঞ্চলের মতো এর ভূগর্ভের পানির স্তর মোটেও সমৃদ্ধ নয়। এর অবস্থা এতই নাজুক যে, গভীর নলকূপ খনন করেও সুবিধা করা যায় না ঠিকমতো। তবে এখানে পাতকুয়া খনন করলে পানি জমে। এর পানি দিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ ও গৃহস্থালির কাজ চলে কিন্তু কৃষিকাজ চালানোটা বড্ড মুশকিল। কম সেচে ফলন দেয় এমন সব ফসল চাষ হয় কিন্তু তা চাহিদা মেটায় না। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যই পাতকুয়া খনন ও পরিচালনার পদ্ধতিগত আধুনিকায়নের মাধ্যমে চাষ উপযোগী করার চেষ্টা প্রক্রিয়াধীন। এর মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন চাহিদা তো মিটবেই, চালানো যাবে চাষের কাজও। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বাস্তবায়িত হচ্ছে পাতকুয়াগুলো, যা আগের পাতকুয়ার চেয়ে ভিন্ন।
আগের পাতকুয়াগুলোর মাধ্যমে সন্তোষজনক পানি পেতে ৪৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১২০-১৩০ ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করা প্রয়োজন হতো। এখান থেকে কষ্ট করে পানি বালতিতে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে তুলতে হয়, যা খুব কষ্টসাধ্য। আধুনিক পদ্ধতিতে এ সমস্যাটা দূর করা হয়েছে। এখন সোলার প্যানেল ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করা যায়। সোলার প্যানেলগুলো প্রচলিত লম্বা সারিতে ব্যবহার না করে মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে কিছুটা ফানেল আকৃতি করে স্থাপন করা হয়, যাতে বৃষ্টির পানি জমে কুয়ায় পতিত হয়। আর পাতকুয়ায় জমা হওয়া পানি সাবমারসিবল সোলার পাম্প ব্যবহার করে কুয়ার ওপর স্থাপিত ট্যাংকে জমা করা হয়।
ট্যাংকে জমাকৃত পানি পিভিসি পাইপলাইনের মাধ্যমে পাতকুয়ার কাছে স্থাপিত ট্যাপ হতে পান করা যায়। সংগ্রহ করা যায় গৃহস্থালির কাজের জন্যও। আর চাষযোগ্য জমিতে পাইপলাইন নির্মাণ ও বিভিন্ন স্থানে ফসেট বা আউটলেট স্থাপন করে এখান থেকে সরাসরি বা ফিতা পাইপের মাধ্যমে সেচের পানি ব্যবহার করা হয়।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে খননকৃত কয়েকটি পাতকুয়ার কার্যক্রম বর্তমানে সোলার পাম্পের সাহায্যে পরিচালনা করা হচ্ছে। উপকারভোগী লোকজন এ পানি খাবার বা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা ছাড়াও পাচ্ছে
নানাবিধ সুবিধা। কম সেচ লাগে এমন ফসল আলু, পটোল, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, শসা, বেগুন, শিম, লাউ, ছোলা, মসুর প্রভৃতি চাষ করে লাভবানও হচ্ছে। এর মাধ্যমে বৃষ্টির পানিও সংরক্ষণ করা যায়।
বরেন্দ্র এলাকায় পাতকুয়া খননের মাধ্যমে ‘স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন’ নামে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য পাতকুয়ার মাধ্যমে সংরক্ষিত পানি দ্বারা স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন ও খাবার পানিসহ গৃহস্থালি কাজে পানি সরবরাহ করা। প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী বিভাগের ঠাঁঠাঁ বরেন্দ্র এলাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার তিনটি (চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, গোমস্তাপুর ও নাচোল) এবং নওগাঁর ছয়টি (নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, পতœীতলা, ধামইরহাট, সাপাহার ও পোরশা) মোট ৯টি উপজেলায় ৪৫০টি পাতকুয়া খনন করে ১৩৫০ হেক্টর জমিতে স্বল্প সেচের ফসল উৎপাদন করা। একই সঙ্গে ৩৩ হাজার ৭৫০ মানুষকে খাবার ও গৃহস্থালির কাজে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।