নারীর ঝুঁকি অস্টিওপোরোসিস

মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ হাড়। হাঁটাচলাসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এর বিকল্প নেই। তাই এর যত্ন নিতে হবে। সামান্য সমস্যা বোধ করলেও দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখতে হবে জীবনই গতি, গতিই জীবন।

আক্ষরিক অর্থে অস্টিওপোরোসিস বলতে বোঝায় ছিদ্রযুক্ত হাড়। এ রোগের কারণে হাড়ে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়, হাড়ের স্বাভাবিক গঠন নষ্ট হয়ে যায়। ক্রমেই হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ফলে হাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। হাড়ের এ ক্ষয় সাধারণত নীরবে ঘটতে থাকে। সাধারণত প্রাথমিক ধাপে এর কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। অস্টিওপোরোসিসে কোমরের হাড়, মেরুদণ্ড ও হাতের কবজির হাড় সবচেয়ে বেশি ভঙ্গুর হয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে মহিলাদের মেনোপজ-পরবর্তী সময়ে অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রতি তিনজন মহিলার একজন এ অস্টিওপোরোসিসজনিত হাড় ভাঙার শিকার।

অস্টিওপোরোসিসের নানা কারণ রয়েছে। শৈশবে হাড় গঠনের সময় পর্যাপ্ত ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড়ের স্বাভাবিক গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া হাড় গঠনে কিছুটা পারিবারিক প্রভাবও রয়েছে। ব্যায়ামের অভ্যাস ও দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণের ওপরও হাড়ের গঠন অনেকাংশ নির্ভরশীল। এছাড়া বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস হতে পারে।

 

উপসর্গ ও লক্ষণ

আগেই জেনেছেন, অস্টিওপোরোসিসে নীরবে হাড় ক্ষয় হতে থাকে। হাড় ভাঙার মাধ্যমেই এর উপস্থিতি প্রথমবারের মতো টের পাওয়া যায়। হাড়ের ব্যথা বা অল্প আঘাতে হাড় ভেঙে যাওয়াও হতে পারে এর প্রথম লক্ষণ। মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙার ফলে কোমরে হাড়ের গঠনগত ত্রুটি, শরীরের উচ্চতা কমে যাওয়াÑ এমনকি মেরুদণ্ডের ভেতরে অবস্থিত স্নায়ুর ওপর চাপের প্রভাবে তীব্র ব্যথাও অনুভূত হতে পারে।

 

শনাক্তকরণ

হাড়ের সাধারণ এক্স-রের মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস ধারণা করা গেলেও সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। হাড় ভাঙার আগেই সঠিক সময়ে অস্টিওপোরোসিস শনাক্ত করার জন্য বোন মিনারেল ডেনসিটি পরীক্ষাটি করা হয়ে থাকে। সাধারণত কোমর বা মেরুদণ্ড হাড়ের ডেস্ক স্ক্যানের মাধ্যমে হাড়ের ঘনত্ব নিরূপণ করা হয় এবং তা থেকে হাড় ভাঙার ঝুঁকি নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা নির্ধারণ করা যায়। এছাড়া রক্তের কিছু পরীক্ষার মাধ্যমেও (বোন টার্নওভার মার্কার) অস্টিওপোরোসিসজনিত হাড় ভাঙার ঝুঁকি মাপা হয়ে থাকে।

 

বিএমডি অর্থাৎ বোন মিনারেল ডেনসিটি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত বিএমডির মাত্রাগুলো জেনে নিতে পারেন

* স্বাভাবিক : ঞ ংপড়ৎব -১ ঝউ-এর সমান বা ওপরে (পজেটিভ)

* অস্টিওপেনিয়া : ঞ ংপড়ৎব -১ ঝউ

থেকে-২.৫ ঝউ

* অস্টিওপোরোসিস : ঞ ংপড়ৎব – ২.৫ ঝউ

থেকে কম

এ ছকটি মেনোপজ-পরবর্তী নারীর জন্য প্রযোজ্য। পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীর অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি ৫.১%। যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৩.১%। মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজ-পরবর্তী হরমোনের ইমব্যালেন্সের (ইসট্রোজেন, প্রজেস্টরন) কারণে অস্টিওপোরসিসের ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে।

প্রতিরোধ

অন্য অনেক রোগের মতোই চিকিৎসার চেয়ে অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ অনেক সহজসাধ্য। প্রতিরোধের তিনটি ধাপ হলোÑ

*পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি। সূর্যের আলো হচ্ছে ভিটামিন ডি-এর উৎকৃষ্ট উৎস। এছাড়া তৈলাক্ত মাছ, ডিমের কুসুমেও কিছু পরিমাণ ভিটামিন ডি রয়েছে। এসব খাদ্যে বেশি কোলেস্টেরল থাকায় এ ধরনের খাদ্য নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি গ্রহণ করা উচিত নয়। তাই ভিটামিন ডি পেতে হলে সূর্যরশ্মির ওপরই নির্ভর করা ভালো।

*পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম। দৈনিক ক্যালসিয়ামের চাহিদা নানা বয়সে নানা রকম। গড়ে তিন বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম, চার থেকে আট বছর পর্যন্ত ৮০০ মিলিগ্রাম, নয় থেকে ১৮ বছর বয়সে এক হাজার ৩০০ মিলিগ্রাম, ১৯ থেকে ৫০ বছরে ১০০০ মিলিগ্রাম ও ৫১ বছর বা তদূর্ধŸদের এক হাজার ২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খাবার থেকে ক্যালসিয়াম নেওয়া উচিত। দুধ ছাড়াও বাদাম, শাকসবজি, হাড়সহ ছোট মাছে প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে।

*নিয়মিত ব্যায়াম। ব্যায়ামের মাধ্যমেও সুস্থ হাড় পাওয়া সম্ভব। ব্যায়াম শুরু করার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। তবে যত তাড়াতাড়ি ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তোলা যাবে, এর উপকারিতা তত বেশি। ওজনবাহী ব্যায়ামগুলোই অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধের জন্য বেশি উপযোগী। শারীরিক পরিশ্রম যেমন সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, নিয়মিত হাঁটা, সম্ভব হলে জিমে যাওয়া। প্রত্যেকটি স্কুল-কলেজে খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে করে শিশুরা ছোট থেকে খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের শরীরকে ফিট রাখতে পারে এবং হাড় ও মাংসপেশি শক্ত হয়।

 

চিকিৎসা

সুখের বিষয় এই যে, অস্টিওপোরোসিস এখন একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক জীবনযাত্রা ও চিকিৎসা।

অস্টিওপোরোসিস চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো হাড় ভাঙার ঝুঁকি কমানো। জীবনযাত্রায় নিচের নিয়মগুলো মেনে চলা উচিত।

* ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করা।

* নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া।

সঠিক জীবনযাত্রার সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট যেমন খধনপধষ উ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা এবং মেনোপজ-পরবর্তী মহিলাদের ক্ষেত্রে অস্টিওপোরোসিসজনিত হাড় ভাঙা প্রতিরোধে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়া এর চিকিৎসায় বিসফসফোনেট, ইবানড্রোনিক এসিড, জোলেনড্রোনিক এসিড জাতীয় ওষুধ ব্যবহƒত হয়। যা শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবনযোগ্য। অস্টিওপোরোসিসের জন্য ওষুধ কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। অনেকে মনে করেন, কোনো অসুস্থতার কারণে হাড় ক্ষয় বা হাড় বেড়ে গেছে, কথাটা ঠিক নয়। হাড় ক্ষয়, পূরণ ও বেড়ে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে মন খারাপ করা যাবে না বরং সাহস সঞ্চয় করতে হবে। মনে করতে হবে, এটা কোনো রোগ নয়।

শারীরিক অ্যাক্টিভিটিস বাড়ান, হাঁটাচলা করেন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন। তাহলে অস্টিওপোরোসিস অনেক ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের এ ধরনের রোগ খুবই কম হয়। কারণ তারা শারীরিক পরিশ্রম করে আর শহরের ছেলেমেয়েরা হাঁটাচলা-খেলাধুলার সুযোগ না থাকায় শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই বেড়ে উঠছে। শরীরের ওজন বাড়লে অস্টিওপোরোসিস বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আবার মোটা মানুষ যদি নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাহলে শুধু অস্টিওপোরোসিসই নয়, নানা রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। সবসময় খেয়াল রাখবেন, শরীরের ওজন যেন না বাড়ে। তামাক, জর্দা, ফাস্টফুড, পানীয়, চর্বি জাতীয় খাবার সর্বদা এড়িয়ে চলা ভালো। বয়স ৪০ হলে খাওয়া-দাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনুন।

 

অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন

এমবিবিএস, এমএস (অর্থো)

চিফ কনসালট্যান্ট ও বিভাগীয় প্রধান

অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগ

ল্যাবএইড হাসপাতাল

(সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল)

অনুলিখন: জাহিদ হাসান

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০