নাজমুল হুসাইন: মায়ের রক্তে হেপাটাইটিস-বি থাকায় প্রসবের পরপরই সন্তানকে টিকা দেবেন একরামুল হক। তাই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে সন্তান প্রসবের পর টিকাটি কিনতে যান সেখানকার ‘ইত্যাদি মেডিসিন সেন্টারে’। বিক্রয়কর্মী ব্যবস্থাপত্রে থাকা (০.৫ মিলি) হেপাবেগ নামে প্রতিষেধকের মূল্য তিন হাজার ৭০০ টাকা বলে জানান।
দাম নিশ্চিত হতে মোড়কের গায়ে লক্ষ করেন একরামুল। তবে হেপাবেগে কোনো বিক্রয়মূল্য লেখা নেই। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলে তাকে বলা হয়, ‘বিদেশি ইনজেকশন বলে দাম উল্লেখ নেই। সবখানে এ দামেই বিক্রি হয় টিকাটি।’
বার্থ ডোজ হিসেবে প্রতিষেধক না কিনে কোনো উপায় নেই একরামের। ফলে বাধ্য হয়েই ওই দামেই কেনেন তিনি। এদিকে শাহবাগে ওষুধের মার্কেটে সাথী আক্তারও গত বছর ‘হেপাবেগ’ কিনেছেন দুই হাজার ৭০০ টাকায়। এবার কিনেছেন তিন হাজার ১৫০ টাকায়।
ভিন্ন দামে একই প্রতিষেধক কিনেছেন শুধু একরামুল বা সাথী আক্তারই নন। সারা দেশে এই প্রতিষেধক বিক্রি হচ্ছে ইচ্ছেমতো দামে। বাস্তবেও এর সঠিক দাম জানেন না ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই। টিকাটির মোড়কেও কোনো মূল্য নেই। যা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আর মূল্য উল্লেখ না থাকায় ইচ্ছেমতো দামে বিক্রির সুযোগও বেশি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে কমপক্ষে আট ভাগ লোক হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের জীবাণু বহনকারী। ফলে এ অবস্থায় আক্রান্ত ও পূর্ববর্তী ব্যবস্থায় প্রতিষেধক গ্রহণের হারও অনেক বেড়েছে। তবে সে সুযোগে দেশে এ রোগের প্রতিষেধক নিয়ে চলছে চরম অরাজকতা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুন-আল-মাহতাব শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এসব হেপাটাইটিসের প্রতিষেধক বিদেশ থেকে আমদানি করা। তবে রোগীরা বিভিন্ন সময়ই তা সঠিক দামে কিনতে পারছেন না। ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে দাম। কিন্তু সবাই যেখানে এ ভাইরাল রোগ প্রতিরোধে যুদ্ধ করছে, সেখানে এমন বৈষম্যপূর্ণ ও অনিয়ন্ত্রিত দাম খুবই উদ্বেগজনক। এতে রোগী যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে কমবে টিকা গ্রহণের প্রবণতাও।’
সরেজমিনে রাজধানীর ফার্মেসিগুলোয় দেখা গেছে এমনটাই। ‘হেপাবেগ’ নামের প্রতিষেধকটি দুই হাজার ৭০০ টাকা থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। একই মার্কেটে একেক দোকানে টিকাটির দাম একেক রকম। শুধু হেপাবেগই নয়, হেপাটাইটিসের বিভিন্ন প্রতিষেধকই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। সরবরাহ সংকটের মতো ক্ষেত্রবিশেষে এর দাম হয় কয়েকগুণ।
শাহবাগে মেডিকোস ফার্মেসির সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এর কোনো নির্ধারিত দাম নেই। হাতেগোনা আমদানিকারক প্রতিষেধকটি আনছে। তারা আমাদের যে দামে সরবরাহ করছে, কিছু লাভে আমরাও সে দামেই বিক্রি করছি। কিন্তু প্রায়ই এসব প্রতিষেধকের দাম বাড়ায় আমদানিকারকরা।’
জানা গেছে, মা ও শিশুর রক্তে নেগেটিভ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস থাকলে বা তার সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও এই হেপাবিগ ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। যা রক্তকে পজিটিভ করে। এছাড়াও ধরনবিশেষে হেপাটাইটিসের আরও কয়েক ধরনের প্রতিষেধক বাজারে রয়েছে। একই ধরনের আমদানি করা ওষুধ ও দেশে তৈরি ওষুধের মধ্যে দামের ফারাক আকাশ-পাতাল।
এদিকে জীবন রক্ষাকারী এসব প্রতিষেধক বেশি দামে কিনেও নেই স্বস্তি। কারণ, দেশে এনজিও সংস্থাসহ নিজ উদ্যোগে নেওয়া এসব হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিনের আসল-নকল যাচাই হয় না। এসব আসলে কতটা নিরাপদ, তা জানেন না কেউ। মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা পেতে হয়তো পুরো পরিবারই গ্রহণ করছে রোগপ্রতিরোধকারী ভ্যাকসিনের নামে এই অনিরাপদ ওষুধ। দেশে এ পর্যন্ত প্রচুর নকল হেপাটাইটিস টিকা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়েছি। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এসব প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
Add Comment