কাজী সালমা সুলতানা: ঈদ যায়, ঈদ আসে। পূজা যায় আবার পূজা আসে। আসে বড়দিন, আসে জন্মাষ্টমী। নানা ধর্মের এমনই সব বর্ণিল পার্বণের মাঝে জীবন চলে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের। আসে পহেলা বৈশাখ, বর্ষা উৎসব, নবান্ন উৎসব ও পহেলা ফাল্গুন। এজন্যই বলা হয়, এখানে ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। যদিও এই প্রবাদটির ১৩ পার্বণ বলতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠানকেই বোঝানো হয়, তবুও এখানে সব ধর্মের মানুষেরই রয়েছে আনন্দঘন ধর্মীয় পার্বণ। আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাধারণত দুটি রূপ লক্ষ করা যায়। একটি অংশ হচ্ছে একেবারেই ধর্মীয় আচার, আরেকটি অংশ সামাজিক আচার। এই সামাজিক অংশটুকু ধর্মীয় বিশ্বাসের সীমা ছেড়ে সমাজের সব মানুষের কাছে হয়ে ওঠে আনন্দের। সমাজের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করার মাঝে লুকিয়ে থাকে প্রকৃত উৎসবের আমেজ। ধর্মের এই সর্বজনীন অংশটুকুই সামাজের সব মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে ভিন্ন এক আবহ। আর এজন্যই বলা হয়ে থাকে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উৎসবের অংশটুকু প্রকৃতপক্ষে সমাজকে সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে, সমাজে সৃষ্টি করে সম্প্রীতির বন্ধন।
আবহমানকাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাঝে বসবাস করে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। রক্তের বন্ধন না থাকলেও একে অন্যের আপদ-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর কৃষ্টি এখানকার মানুষের সহজাত। বিশ্বের অন্য কোথাও এমন সহমর্মিতা লক্ষ করা যায় না। এখানকার বাসিন্দারা নিজেরা সাধারণত প্রতিবেশীর জন্য বিপদ বা সমস্যার কারণ হয় না, বরং একটি পরিবারের মতোই অবস্থান করে ভিন্ন পরিবারের বাসিন্দা হয়েও। সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান এখানে সবসময় বিরাজমান। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে বসবাস করে, কিন্তু সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানের জন্য ধর্ম কখনোই প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়নি।
ভারতবর্ষের বাসিন্দাদের এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আর কোনোখানে দেখা যায় না। এ কারণেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে বা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনারই প্রতিফলন ঘটার বিষয়টি সুস্পষ্ট। তাই ধর্মের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে বিভেদের রেখা টানা শুরু করে ব্রিটিশ শাসকরা, তাদের শাসনব্যবস্থাকে প্রলম্বিত করতে ধর্মের বিষয় সামনে নিয়ে আসে। যদিও ব্রিটিশ শাসকেরা এ ভূখণ্ডের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী প্রধান যে দুটি ধর্ম হিন্দু ও মুসলমান, তার কোনোটিতেই বিশ্বাসী ছিল না। তবুও এ বিষয়টি সামনে টেনে এনে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা। সে সময় থেকেই মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। তার পরও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিভেদ তেমন রেখাপাত করতে পারেনি।
তবে ভারতবিভক্তির ঘটনাটি ব্রিটিশদের সৃষ্ট সেই ধর্মীয় বিভেদের সূত্র ধরেই। অথচ ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে ধর্ম কখনোই বিবেচ্য বিষয় ছিল না। ভারতবিভক্তির জন্য যেসব নেতাদের দায়ী করা হয়, তাদেরও অধিকাংশই ভারতের বিভক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। পাকিস্তানের জনক বলে খ্যাত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ নিজেও প্রথম দিকে ভারত বিভক্ত করে স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়ে বিশ্বাসী ছিলেন না। পরিস্থিতি ক্রমেই তাকে সেদিকে ঠেলে দিয়েছিল। আর সেই পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। এই পাকিস্তান সৃষ্টির পর সুখকর অনুভূতি আর পাওয়া যায়নি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের ফলে ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। ভারতে মুসলমানদের ওপর এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বা আজকের বাংলাদেশে হিন্দুদের নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। সে সময়ের নেতারা এ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। নেতাদের অপরিণামদর্শিতার কারণে অসংখ্য মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়, যা এ ভূখণ্ডে অতীতে কখনোই ঘটেনি।
প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এখানে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতার পদবিপ্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে আবহমানকালের ঐতিহ্যটি ম্লান হয়ে পড়ে। এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অসংখ্য হিন্দু ভারতে এবং ভারত থেকে অসংখ্য মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতায় ধর্মের বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তির সংগ্রাম চলেছে ধর্মের বিষয়টিকে পেছনে ফেলে। কারণ ধর্মের বিশ্বাসে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের মানুষের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়ন চলেছে ধর্মের বিশ্বাসের বাইরে। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে তারা নাগরিকেদের মধ্যে ধর্মের বিষয়টি আর বিবেচনায় রাখেনি। এদেশের সম্পদ লুটপাটের সঙ্গে এখানে বসবাসরত মুসলমানদের স্বার্থও কুক্ষিগত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা। প্রকৃত রাষ্ট্রীয় শোষণ-নিপীড়নের ক্ষেত্রে ধর্ম কোনো বিবেচ্য বিষয় থাকে না, তা বিবেচনায় রাখার কোনো সুযোগও নেই। আর তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্বের কবর রচনা করে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সব মানুষের অর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের অংশগ্রহণে স্বাধীনতার সংগ্রাম এগিয়ে গেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের সব মানুষ জীবনপণ যুদ্ধ করেছে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের প্রাধান্য পাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তর হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধানও সে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে স্থান পেয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সেই চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয় রাজনৈতিক শঠতার কারণে। স্বাধীনতার চেতনায় যে ধর্মনিরপেক্ষতা সাংবিধানিক মর্যাদা লাভ করে সেটিও পরিবর্তিত হয়ে যায় ধর্মীয় বিশ্বাসে নয়, রাজনৈতিক অসততার কারণে। এ কারণে সম্প্রতি আমাদের দেশের কিছু ঘটনা এ অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ম্লান করে দিচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে কোথাও কোথাও প্রতিমা ভেঙে ফেলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে। দেখা যায়, কোথাও কোথায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব ঘটনার পেছনের হোতা। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবেই দেখতে চাই। তারপরও যখন গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন সংবাদ আসে, তখন কষ্ট লাগে। যারা এসব ঘটনার পেছনের কুশীলব, খোঁজ নিলে দেখা যায় তারা নিজেরা কখনও ঠিকমতো নিজের ধর্ম পালন করে না। তারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে না, কিন্তু অন্য ধর্মের অনুসারীদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের নিজের অশুভ চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়। তারা প্রকৃতপক্ষে নিজের ধর্ম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে না, বা নিজের ধর্মের আদেশ-নিষেধও মানে না। এসব অপকর্মের পেছনে থাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি দেখানো। এভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পদ গ্রাস করাই তাদের মূল লক্ষ্য। মদিনা সনদ সম্পর্কে তারা অবহিত থাকলে বা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণ সম্পর্কে জানা থাকলে প্রতিমা ভেঙে ফেলা বা অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মতো জঘন্য কাজে তারা লিপ্ত হতে পারত না। আবার দেখা যায়, অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকে। ভারতে গরু জবাই দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করা সে দেশের ক্ষমতাসীন বিজেপির স্থূল রাজনৈতিক অপকর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। একইভাবে ২০০১ সালে আমাদের দেশে জামায়াত-নিয়ন্ত্রিত চারদলীয় জোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। ধর্মীয় রাজনীতির এই অপতৎপরতার কারণে শত শত বছর ধরে বসবাস করেও ভারতে মুসলমানরা স্বাধীনভাবে সে দেশে ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতে পারে না। একইভাবে এদেশেও একশ্রেণির রাজনীতিকের কারণে বা কিছু অতিলোভী মানুষের সম্পদ দখলের মানসিকতার কারণে হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির এটাই হচ্ছে কূপমণ্ডূকতা।
ইসলাম ধর্মের বড় দুটি উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এ দুটি বড় অনুষ্ঠানের একটি অংশ হলো সকালে নামাজ আদায় করা বা সকালে নামাজ আদায় শেষে পশু কোরবানি দেওয়া। কিন্তু আরেকটি অংশ হচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে মিষ্টান্ন বা মজাদার খাবার তৈরি করা এবং আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীর মাঝে তা বিলানো বা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া। একইভাবে হিন্দুদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা। এ পূজায় প্রতিমা তৈরি, তাতে পূজা দেওয়া বা প্রতিমা বিসর্জন এসব হচ্ছে যারা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী তাদের জন্য। কিন্তু এ পূজাকে কেন্দ্র করে যে নাচ, গান, বাজনা, প্রসাদ বিতরণ বা মজাদার খাবার বিতরণ চলে, সেটি কিন্তু সবাই মিলে উপভোগ করা হয়। এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আনন্দ উপভোগে কোনো বাধা থাকে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই মিলেই আনন্দ উপভোগ করে। এখানেই ধর্মের সামাজিক রূপ নিহিত। এখানে নিহিত রয়েছে ধর্মের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হওয়ার মন্ত্র। সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধন একটি দেশকে সম্মানিত করে। এই মন্ত্রই পারে আমাদের দেশে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করে দেশকে এগিয়ে নিতে।
সাম্যের কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়
‘গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান…’
গণমাধ্যমকর্মী