‘২০ বছরে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ল ১০৯ গুণ’ শিরোনামে গতকালের শেয়ার বিজে যে প্রতিবেদন এসেছে, সঙ্গত কারণেই তা উদ্বেগ জোগায়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এমন খবর হতাশার।
সম্প্রতি সংসদে অর্থমন্ত্রী প্রদত্ত তথ্যের বরাত দিয়ে আমাদের প্রতিবেদক জানান, বিচার না হওয়া, সীমাহীন দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রতি বছর বাড়ছে ঋণখেলাপির সংখ্যা ও পরিমাণ। গত ৩০ জুন পর্যন্ত এর সংখ্যা দুই লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন। ১৯৯৭ সালে দেশে ঋণখেলাপি ছিল দুই হাজার ১১৭ জন। অর্থাৎ ২০ বছরে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ১০৯ গুণ। এ চিত্র থেকে স্পষ্ট, ঋণ প্রদানে আমাদের উৎসাহ বেশি, আদায়ে নয়। যে জন্য ঋণ নেওয়া হচ্ছে, সে কাজে ব্যয় হচ্ছে না আর খেলাপি হতে অনিচ্ছুকরা ঋণ পাচ্ছেন না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনায় লোকসানের কারণে ঋণগ্রহীতা খেলাপি হতেই পারেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন অনেকে। মামলা করেও এ ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। কারণ ঋণগ্রহীতারা প্রভাবশালী; তাছাড়া তারা নিয়োগ করেন দক্ষ আইনজীবী। অর্থঋণ আদালতে নিষ্পত্তি হলেও এর বিরুদ্ধে আপিলের পর মামলাগুলো দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে। এদিকে করের টাকায় প্রতিবছর বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগাতে হচ্ছে সরকারকে। দুর্নীতি, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর এ কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি নিচ্ছে প্রকট রূপ। ঘাটতিও মেটানো হচ্ছে অগ্রহণযোগ্য উপায়ে।
সাধারণত যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে না নিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন।
ব্যাংকের প্রধান কাজ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ঋণ দেওয়া এবং তা আদায়। ব্যাংকের মূল সম্পদই হলো ঋণ। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুশাসিত ও শক্তিশালী ব্যাংক খাত অপরিহার্য। আর খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি ভাঙতে জবাবদিহির বিকল্প নেই। খেলাপি ঋণ আদায়ে সদা সক্রিয়ও থাকতে হবে।
সামান্য টাকা চুরির জন্য ছিঁচকে চোর গণপিটুনির শিকার হয় আর বড় ঋণখেলাপিরা উল্টো সামাজিক মর্যাদা ভোগ করছে। এদের নিবৃত্ত করতে ব্যাংক খাতে সুশাসনই যথেষ্ট নয়, সামাজিকভাবেও তাদের বয়কট করতে হবে। বর্তমানে খেলাপি ঋণ থাকলে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। কিন্তু খেলাপি প্রার্থীরা নির্বাচনের আগে যৎসামান্য কিস্তি পরিশোধ করে ঋণ পুনঃতফসিল করিয়ে নেন। নির্বাচনে জিতলে ঋণ নেন নতুন করে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা (সিআইপি) রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন; তেমনি ঋণখেলাপিদের কিছু সুবিধা প্রত্যাহার করা যেতে পারে। সিআইপিদের নাম যেভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়, ঋণখেলাপিদের নামও সেভাবে প্রকাশ করতে হবে। তাহলে লোকে জানবে, যিনি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয়, উপাসনালয়ে প্রভৃতিতে অনুদান দিচ্ছেন, তিনি ব্যাংকের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন ঋণের মাধ্যমে।
অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ খেলাপি ঋণ আদায়ে যথেষ্ট বলেই বিবেচিত। অর্থ লোপাটের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সদিচ্ছা এবং সব পর্যায়ে প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে বিদ্যমান আইনেই এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
আইনের যথাযথ প্রয়োগেই খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব
