ট্রেডমার্ক আবেদনের ৭৮ শতাংশ বাতিল: অনুকরণ করা পণ্য ও সেবার স্বত্ব চান ব্যবসায়ীরা

নাজমুল হুসাইন: বাজারে জনপ্রিয় চিপস পটেটো ক্র্যাকার্স। তবে দেশের অধিকাংশ খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানই একই নামের চিপস বিক্রি করছে। বর্তমানে এমন অবস্থা যে, প্রকৃত ‘পটেটো ক্র্যাকার্স’-এর স্বত্বাধিকারী কে সেটাই ভুলে গেছেন ক্রেতারা। শুধু খাদ্যপণ্যেই নামের বিভ্রান্তি তা নয়। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের নামেও এমন অনুকরণ হচ্ছে। জনপ্রিয় হওয়ার পরই রাজধানীতে ‘ফেরদৌস’ বা ‘রেমন্ড’ নামে শত শত টেইলার্স চোখে পড়ে। কেউবা আসল নামের সঙ্গে দ্য, কেউবা দি, কেউবা নিউ অথবা প্লাস লাগিয়ে চালাচ্ছেন ব্যবসা।
পণ্য, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যবসাক্ষেত্রে এ ধরনের নকল বা অনুকরণ প্রতিরোধে কিছু ব্যবস্থাও রয়েছে। বিশেষ করে নতুন পণ্য বা সেবাকে অন্যের থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র রাখতে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে নেওয়া হয় ‘ট্রেডমার্ক’ ও ‘ডিজাইন’ নিবন্ধন। ফলে দেশে প্রতিনিয়তই ব্যবসা পরিধির সঙ্গে বাড়ছে ট্রেডমার্ক, ডিজাইন নিবন্ধনের হারও। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ ট্রেডমার্ক নিবন্ধন হচ্ছে, এর থেকেও কয়েকগুণ আবেদন বাতিল হচ্ছে নকল বা অন্যের পণ্য হুবহু নকলের জন্য।
পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতরের হিসাবে, দেশে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত পণ্য ও সেবার জন্য ট্রেডমার্ক নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে দুই লাখ ২৮ হাজার ৩৮৭টি। কিন্তু নিবন্ধন দেওয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র ৪৯ হাজার ৬৬৯টি প্রতিষ্ঠানকে। অর্থাৎ মাত্র ২২ শতাংশ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রেডমার্ক দেওয়া হয়েছে।
আবেদনের পরিপেক্ষিতে নিবন্ধন প্রাপ্যতার হারই অন্যের অনুকরণের কারণে কম জানিয়ে অধিদফতরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (ট্রেডমার্কস) ওবায়দুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের ট্রেডমার্ক নেওয়ার ক্ষেত্রে অনুকরণ প্রবণতায় আমরা কাক্সিক্ষত পরিমাণ নিবন্ধন দিতে পারি না। ট্রেডমার্কের আবেদনে অধিকাংশই মার্কেটে পপুলার পণ্যের অনুকরণ করে চাওয়া হয়। যা ট্রেডমার্ক আইন পরিপন্থী। একে অন্যের অনুকরণ বন্ধেই ট্রেডমার্ক আইন করা, প্রকৃত স্বত্বাধিকারীরা ট্রেডমার্ক নেনই তার স্বত্ব সংরক্ষণের জন্য।
স্বাধীনতার পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৩৫টি ট্রেডমার্ক আবেদন সম্পূর্ণ বাতিল হয়েছে। একাধিকবার সংশোধনের সুযোগ থাকলেও এসব নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। আর এ পর্যন্ত অনিষ্পন্ন রয়েছে ৪৪ হাজার ৩৮৫টি ট্রেডমার্ক আবেদন।
সূত্র বলছে, প্রচলিত পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের নাম অনুকরণ করে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রবণতা বাড়ছে। এতে পণ্য বিক্রি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে প্রকৃত স্বত্বধিকারীর সুবিধা পাওয়া যায়। এছাড়া পণ্য নকল হলেও ট্রেডমার্ক নিয়ে ব্যবসা করলে আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে করেন অনেক ব্যবসায়ী। ফলে পণ্যের ক্ষেত্রে হুবহু নকলসহ অংশিক অনুকরণ করে পণ্যের ট্রেডমার্ক আবেদনই বেশি আসে। এ কারণেই বাতিল হচ্ছে আবেদন।
বাজার ঘুরেও দেখা গেছে ট্রেডমার্কের অপব্যবহারের চিত্র। অধিকাংশ জনপ্রিয় পণ্যের হুবহু নকল বা অনুকরণ করে বিভিন্ন কোম্পানি পণ্য ও সেবা ব্যবহার করছে। ছোট-বড় সব কোম্পানির পণ্যই নকল হচ্ছে। আবার সবাই একে অন্যের পণ্য অনুকরণ করছে। এতে বিভ্রান্তি ও প্রতারণায় পড়ছেন ক্রেতা।
একইভাবে কোনো আবিষ্কৃত পণ্যের আকার-আকৃতি স্বতন্ত্র রাখতে ডিজাইনের নিবন্ধন দেওয়া হয় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর থেকে। ডিজাইন নিবন্ধনের পর শুধু আবিষ্কারক নিজেই অথবা রয়্যালটির বিনিময়ে অন্য কাউকে দিয়ে সে পণ্যের ব্যবসা করতে পারবেন। স্বাধীনতার পর থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত এ ধরনের পণ্য ডিজাইন নিবন্ধনে আবেদন আসে ২৩ হাজার ৫২৯টি। এর মধ্যে ১৫ হাজার ২৭৭টি ডিজাইন নিবন্ধন করা গেছে। আর এক-তৃতীয়াংশ বাতিলের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অন্যের অনুকরণ করা ডিজাইন। যা স্বতন্ত্রতা না থাকায় বাতিল হয়েছে।
ট্রেডমার্ক-ডিজাইনের স্বত্ব বর্তমানে একটি উৎস থেকে পণ্য বা সেবা, অন্য উৎসের পণ্য বা সেবা পৃথক করার একমাত্র উপায়। প্রকৃত ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বা সেবা নিবন্ধনের ওপর ভরসা করে ব্যবসা করছেন। ক্রেতারাও এসব নিবন্ধনে ভরসা করে পণ্য ও সেবার গুণগত মান নির্ধারণ করছেন। সে ক্ষেত্রে অনুকরণ প্রবণতা উদ্বেগজনক বলছেন ব্যবসায়ীরাই।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোবারক আলী বলেন, ‘কোনো একটি পণ্য জনপ্রিয় হয়ে উঠলে সবাই তার অনুকরণ করে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকৃত আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের অনুকরণ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে কোম্পানিগুলোর উদ্ভাবনীও কমে যাচ্ছে। নতুন পণ্য ও সেবা আবিষ্কারে পিছিয়ে পড়ছে দেশ। ব্যবসায়ীদের এমন প্রবণতা ক্ষতিকর।’

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০