ব্যক্তিজীবনে কম-বেশি সবারই কিছু না কিছু মানসিক কষ্ট বা আঘাতের স্মৃতি আছে। মধুর স্মৃতিও কম নয়। কিন্তু যদি কোনো ঘটনা কারও মধ্যে তীব্র কষ্টের জন্ম দেয়, যা তাকে স্বাভাবিক থাকতে কিংবা স্বাভাবিকভাবে দৈনন্দিন কাজ করতে অক্ষম করে তোলে কিংবা কেউ চেষ্টা করেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি ঘটনাটি দ্বারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। অর্থাৎ নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
মনে রাখতে হবে, কষ্টকর কিংবা আঘাতমূলক ঘটনা কেউ কেউ সহজে নিজে থেকে বলতে চান না। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি একাই নিজে থেকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে থাকেন। কখনও কখনও খুব কাছের কিংবা যাকে তিনি বিশ্বাস করেন কিংবা যার ওপর আস্থা রাখা যায় তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান।
আবার কেউ কেউ এমনভাবে ভেঙে পড়েন যেন পাথর হয়ে যান; কারণ ঘটনাটির ভয়াবহতা এত তীব্র বা যন্ত্রণাদায়ক যে, তা পুনরায় স্মরণ করতে চান না। যে কারণে ঘটনাটি নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই লুকিয়ে রাখার পরিণতি হয়তো অনেকেই জানেন না। যে কারণে এই কষ্টের দৈত্য তাকে স্বাভাবিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত করে; যার জটিল পরিণতি হলো মানসিক রোগ।
মানসিক আঘাত পেয়ে যারা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাদের মধ্যে অনেকেই নিজে থেকে চিকিৎসার উদ্যোগ নেন না। পরিবারে আপনজন তাদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করে নিরুপায় হয়ে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। সব সময় মনে রাখতে হবে, আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে নিজে থেকে চিকিৎসা নিতে চান না কিংবা সমস্যা অস্বীকার করে নিজের মধ্যে তা লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা যখন বুঝতে পারেন এবং চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন, তখন প্রায়ই দেখা যায় যে অনেক দেরি হয়ে গেছে! চিকিৎসা যত দ্রুত নেওয়া যায়, ততই ভালো। মানসিক আঘাতের পরিণতি ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হলেও কিছু সাধারণ ঘটনা উল্লেখ করা যায়। যেমন কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার ফলে অঙ্গহানি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নিকটজনকে হারানো, ধর্ষণ, রাজনৈতিকভাবে হয়রানি, ধর্মীয় উম্মাদনার শিকার, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক কলহ, শৈশবে চরম অবহেলা, বাবা-মায়ের অতিশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠী দ্বারা নির্যাতিত, সন্ত্রাস, ছিনতাই কিংবা ডাকাতের কবলে পড়ে ভীত কিংবা আতঙ্কিত হয়ে পড়া, জটিল শারীরিক রোগ, বিয়েবিচ্ছেদ, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ কিংবা গর্ভপাত এরূপ বহু ঘটনা মানসিক আঘাত বা পীড়াদায়ক অনুভূতির জন্ম দিতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রে PTSD রোগের কারণ হিসেবে শনাক্ত। যখন ব্যক্তির মধ্যে PTSD -র মতো জটিল মানসিক রোগ জন্ম নেয়, তখন আর ব্যক্তি উদ্যোগ রোগ নিরাময়ে ততটা ভূমিকা রাখতে পারে না। প্রয়োজন হয় মানসিক চিকিৎসা। যেখানে সমস্যার ধরন ও তীব্রতার ভিত্তিতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। চিকিৎসায় ওষুধের প্রয়োজন হলেও ডাক্তাররা কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
PTSD রোগটি সহজে বোঝার উপায় হিসেবে এ লেখায় কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
PTSD কী
Post Traumatic Stress Disorders.
কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানসিক আঘাত-পরবর্তী সৃষ্ট মানসিক রোগকে সাধারণভাবে চঞঝউ বলা যেতে পারে।
এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি তীব্র ভয়, অসহায়ত্ববোধ, আতঙ্ক বা দুঃসহ যন্ত্রণা বোধ করেন। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া ভিন্নতর হয়; যেমন নিজেদের অতিমাত্রায় উত্তেজিত, বিশৃঙ্খল বা বিক্ষুব্ধ ভাব ছোটখাট বিষয়েও উপস্থাপন করে।
রোগটি বোঝার উপায়
যে ঘটনায় কোনো ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তার পুনরাবৃত্তি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে, কখনও কখনও অনুভূতিহীন হয়ে পড়া, ছোটখাট, এমনকি উত্তেজিত হওয়ার মতো বিষয়ও তাকে স্পর্শ করে না, অর্থাৎ প্রাণহীন মনে হওয়া, শারীরিক চাহিদাগুলো নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা, অতিমাত্রায় আবেগ প্রকাশ, দৈনন্দিন কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন থাকা, ঘুমের মধ্যে খারাপ বা ভয়ের স্বপ্ন দেখা যে কারণে রাতে ঘুমাতে না পারা কিংবা ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম না আসা। আঘাতের ঘটনাগুলো বার বার স্মৃতিতে চলে আসা, কোনো বিষয়ে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানো, অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন, ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করা যে কারণে নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে, নিজেকে স্বাভাবিক জীবন থেকে গুটিয়ে ফেলা এবং সামাজিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলা। মনে রাখতে হবে, এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি সমস্যা সমাধানে নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ নেয় না, এমনকি পরিবারের কাউকেই বিষয়টি বলে না, PTSD রোগের লক্ষণ ঘটনা ঘটার কয়েক সপ্তাহ পর থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লক্ষ্য করা যেতে পারে।
যদিও PTSD’র উৎস বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিজ্ঞতা, তবুও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় এ রোগের ফলে ব্যক্তির শারীরিক অস্বাভাবিকতাও লক্ষ্য করা যায়। যেমন যেসব ব্যক্তির জীবনে মানসিক আঘাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে ভবিষ্যতে বিপজ্জনক কিছু ঘটবে ভেবে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়ে মানসিক আঘাতের ফলে মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তনও হতে পারে। আমেরিকাতে এক গবেষণায় দেখা যায়, শৈশবে মানসিক আঘাত পাওয়া মহিলা যারা বর্তমানে PTSD রোগে ভুগছেন, তাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে যুদ্ধাহত সৈনিক, বিশেষ করে উভয়ের মস্তিষ্কের চিন্তার সহায়ক অঙ্গ হিপোক্যাম্পাস (Hippocampus)-এর আকার ছোট দেখায়। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির মধ্যে চঞঝউ বিকাশ ভালো করবে কি-না, তা নির্ভর করে ব্যক্তির নিজস্ব বিকাশ ও আঘাতের তীব্রতার ওপর।
আমেরিকাতে অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা প্রায় ৭২ জনের ব্যক্তিজীবনে কোনো না কোনো আঘাতের ঘটনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদেরও ভাবা দরকার। বাংলাদেশে প্রায় তিন ভাগ শিশুর কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের অভিজ্ঞাতা রয়েছে। এসব শিশুর মধ্যে কারও ক্ষেত্রে চঞঝউ’র মতো জটিল রোগ জন্ম রয়েছে কি-না, তা কী আমরা বলতে পারি? মানসিক রোগের চিকিৎসায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীরা বর্তমানে PTSD রোগের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বর্তমান বিশ্বে চঞঝউ’র চিকিৎসায় প্রয়োজনবোধে ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপি, বিশেষ করে ঊগউজ ভিত্তিক সাইকোথেরাপিকে গুরুত্ব দেয়। PTSD রোগের চিকিৎসায় EMDR ((Eye Movement Desensitization and Reprocessing) প্রচলিত অন্যান্য যে কোনো পদ্ধতির সাইকোথেরাপির চেয়ে ভালো বলে স্বীকৃত এবং অধিক কার্যকরী, যা গবেষণায় প্রমাণিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ঊগউজ চিকিৎসায় বিশেষত্ব হলো, দীর্ঘ চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। খুব দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়ক। বাংলাদেশে ১৯৯৮ সাল থেকে মানসিক রোগের চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। সবার জ্ঞাতার্থে বলছি, PMRC (PTSD Management and Rehabilitation Centre) একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশে চঞঝউ রোগীদের সেবা প্রদানে ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সেবা পেতে যে কেউ PMRC -এ যোগাযোগ করতে পারেন
সাখাওয়াত শরীফ লিটন
মনোবিজ্ঞানী ও ঊগউজ থেরাপিস্ট
প্রতিষ্ঠাতা: PMRC
Add Comment